- রাজধানী
- শতবর্ষী বিশাল পুকুর যেভাবে কাউন্সিলর পরিবারের পেটে
গেণ্ডারিয়ার ডিআইটি পুকুর
শতবর্ষী বিশাল পুকুর যেভাবে কাউন্সিলর পরিবারের পেটে

রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার শতবর্ষী ডিআইটি পুকুরের পাশে রোববার মানববন্ধন করে এলাকাবাসী - সমকাল
রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার শতবর্ষী ডিআইটি পুকুরে একসময় মানুষ গোসল করতেন। ১৯৬৪ সালে গেণ্ডারিয়া পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য এ পুকুরটির পাশে আরও ১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পরে ১১ একর জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অব্যবহৃত থেকে যায় দুই একরেরও বেশি জমি।
স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর সাইদুর রহমান সহিদ ও তাঁর মেয়ে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের বতর্মান কাউন্সিলর সাহানা আক্তার এ পুকুরপাড় ভরাট করে ভবন ও দোকান বানিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছেন বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা। এর আগে এ পুকুরটির জমির মালিক দাবি করে কাউন্সিলর সহিদ তাঁর স্ত্রী ও শ্যালকের নামে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। সহিদ এবং তাঁর মেয়ে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর।
সহিদের ছেলে যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ জাবিনও বলছেন, তাঁর বাবা এ জমির মালিক নন। অবৈধভাবে মালিকানা পেতে তাঁর বাবা রাজউকের বিপক্ষে মামলা লড়তে কয়েক কোটি টাকা খরচও করেছেন। বাবার এসব দখলদারি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে তাঁর নামে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলাও করেছেন তাঁর বাবা। পুকুরের পাশের জমির মূল মালিক ছিলেন নৌশাদ চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা এখন আমেরিকায় অবস্থান করছেন। তবে তাঁরা জমি নিজেদের দাবি করে মামলা করেছেন। এ মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁদের নিকটাত্মীয় জাকির হোসেনকে।
জাকির হোসেনের দাবি, রাজউকের বিরুদ্ধে এসব মামলায় তাঁরা জয় পেলেও পুকুরের পাশে তাঁরা যান না। কারা দখল করে ভবন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করছেন কিছুই জানেন না তিনি। তবে অনেক টাকা খরচ করে সহিদ কাউন্সিলর এর সংস্কার করেছিলেন। এদিকে পুকুরটি রক্ষায় স্থানীয় ও পরিবেশবিদরা আন্দোলন করছেন। তাতেও বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কাউন্সিলরের বিপক্ষে।
রাজউকের সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পুকুরটি রাজউকেরই। এটি দখলে নেওয়ার জন্য প্রভাবশালীরা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে একটি মামলা করেন। সে মামলা বহু বছর ধরে চলছিল। এর মধ্যেই বেশিরভাগই দখল হয়ে যায়।
রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দখলবাজরা মামলার পর মামলা করায় আমরা পেরে উঠছি না। সর্বশেষ আমরা রিভিউ পিটিশনেও হেরে গেছি। আমরা চাই পুকুরটি রক্ষায় রাজউকের বাইরেও কেউ কথা বলুক। জনস্বার্থে পুকুরটি রক্ষায় সবারই এগিয়ে আসা উচিত।’
জাকির হোসেন সমকালকে বলেন, নৌশাদ চৌধুরী ও তাঁর পরিবার মামলাটি পরিচালনা করতে ২০০৬ সালে তাঁকে দায়িত্ব দেন। মামলায় জয় পেলেও এ পুকুরের জায়গায় তাঁরা কখনও যান না। পুকুরপাড়ে কোনো স্থাপনা, কারখানা বা মার্কেট তাঁদের অনুমতি নিয়ে করা হয়নি। এসব কারা বরাদ্দ দিচ্ছে, কারা ভাড়া আদায় করছে, তিনি কিছুই জানেন না।
সহিদের ছেলে যুক্তরাজ্যের ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ জাবিন সমকালকে বলেন, ‘এর আগে পুকুরের মালিক হিসেবে কখনও তিনি জাকির হোসেন বা অন্য কারও নাম শোনেননি। তাঁর বাবা এর আগে তাঁর সৎমা বুলবুলি বেগম এবং মামা আরিফ হোসেনকে পুকুরের মালিক দাবি করে সাইনবোর্ড টানিয়েছেন। তিনি এলাকার দুই দশকের বেশি সময় ধরে কাউন্সিলর ছিলেন। এ পুকুরের মামলাকে কেন্দ্র করে তাঁর কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তিনি জানতেন এত বড় পুকুর একসঙ্গে ভরাট সম্ভব নয়। তাই আস্তে আস্তে দখল করছেন। আর বর্তমানে পুকুরের সব দোকানের ভাড়া তোলেন তাঁর বাবার ঘনিষ্ঠ মাহবুব। আরও অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য মাহবুবের মাধ্যমে পরিচালনা করেন সহিদ।
সরেজমিন দেখা যায়, ডিআইটি পুকুরের পশ্চিম পাশে দোতলা ভবনে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। এ ভবনটির একটি অংশে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অস্থায়ী কার্যালয়। এর দুই পাশে একটি বড় এমবয়ডারি কারখানা এবং ফুলদানি নামে একটি বড় মার্কেট। এ মার্কেটে রয়েছে শতাধিক দোকান। পুকুরের দক্ষিণ পাড়েও অর্ধশতাধিক দোকান এবং ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়। এ ছাড়া পুকুরের পূর্ব পাশে ছয়টি রিকশার গ্যারেজ, দোকান এবং শ্যামপুর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাফিস হাসানের কার্যালয় রয়েছে।
এসব দোকানের মালিক ও স্থানীয়রাও জানান, পুকুর পাড়ের দোকানের জায়গা বরাদ্দ, অগ্রিম ও ভাড়া আদায় করেন মাহবুব। পুকুর পাড়ে এমবয়ডারি কারখানা করতে এককালীন ৩০ লাখ টাকা আগাম এবং মাসে ৫০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। ড্রিমনাইট গার্ডেন সিটি নামের একটি রেস্টুরেন্ট করতে এককালীন ২০ লাখ টাকা নেওয়া হয়। ড্রয়িং ফ্যাক্টরির জন্য এককালীন ৫ লাখ টাকা এবং মাসিক ৫০ হাজার টাকা এবং ফুলদানি মার্কেট থেকে মাসে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। এ ছাড়া পুকুরের চারদিকে প্রায় দেড় শতাধিক দোকান থেকে মাসে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। ছয়টি রিকশা ও ভ্যান গ্যারেজ থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা ভাড়া আদায় হয়। সব মিলিয়ে শুধু ভাড়াই ওঠে ১০ লাখ টাকার বেশি।
স্থানীয়রা জানান, জাকির মামলা করলেও এর পেছনে অর্থ খরচ এবং কলকাঠি নেড়েছেন সাবেক কাউন্সিলর সহিদ। আদালত থেকে রায় পাওয়ার পরে জাকিরকে ৩০ লাখ টাকা এককালীন দিয়ে তিনি সেখানে মার্কেট ও ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। আগে কম জায়গা ভরাট করলেও সম্প্রতি বড় অংশ ভরাট এবং ভবন নির্মাণ শুরু করেন।
ড্রিম নাইট গার্ডেন সিটি রেস্টুরেন্টের মালিক নাজমুল হাসান সমকালকে বলেন, পুকুর পাড়ের এ জায়গাটি আগে ময়লায় ভর্তি ছিল। তিনি জায়গাটির তত্ত্বাধায়ক মাহবুবের অনুমতি নিয়ে এখানে ময়লা পরিষ্কার করে মাটি ফেলে জায়গাটির সৌন্দর্যবর্ধন করে রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করেছেন। এখানে ময়লা পরিষ্কার, মাটি ফেলা, সৌন্দর্যবর্ধন এবং গাছ লাগাতে প্রায় ১২ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে তাঁর। এখনও কোনো ভাড়া দেন না। তবে ভবিষ্যতে ভাড়া দিতে হবে। জাকির হোসেনের সঙ্গে তাঁর কখনও দেখা হয়নি বা কথাও হয়নি।
মাহবুব সমকালকে জানান, জাকিরই তাঁকে পুকুরের জায়গায় ভবন, মার্কেট বানাতে অনুমতি দেন। আগে পুকুরটি পুরোটাই ময়লার স্তূপ ছিল। মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেত। পরে এর মালিক ৯ লাখ টাকা খরচ করে পুকুর পরিষ্কার করেছেন। আবার যাতে ময়লা না পড়ে, তাই চারদিকে দোকান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, কাউন্সিলরের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। আর কাউন্সিলরের অস্থায়ী কার্যালয় এবং আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে কোনো ভাড়া নেওয়া হয় না। পুকুর পাড়ে গ্যারেজসহ টং দোকান করেছেন এলাকার গরিব মানুষ। তাঁদের কাছে শুধু বিদ্যুৎ বিল নেওয়া হয়। আর পুকুরের পূর্ব ও উত্তর পাশের দোকানগুলো পুড়ে ক্ষতিগ্রস্তরাই এখন বিল্ডিং করছেন। তাঁদের কাছেও কোনো টাকা নেওয়া হয়নি।
গেণ্ডারিয়া ডিআইটি পুকুর রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ইব্রাহিম আহমেদ রিপন সমকালকে বলেন, রাজউক কোনো জমি অধিগ্রহণ করে গেজেট প্রকাশ করলে সে জমি আর ব্যক্তিমালিকানায় থাকে না। এছাড়া এ জমির আগের মালিকরা দেশে থাকেন না। মূলত পুকুরটি ভোগদখল করতে সাবেক কাউন্সিলর সহিদ ও তাঁর মেয়ে চেষ্টা করছেন। তাঁরা সিটি করপোরেশনের ময়লা পুকুরে ফেলেন। এ পুকুরটিতে এক সময় আমরা গোসল করেছি। এলাকার মানুষ সবসময় ব্যবহার করেছেন, আমরা পুকুরটি কাউকে বন্ধ করতে দেব না।
এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল রোববার কাউন্সিলর সাহানার অস্থায়ী কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁকে এবং তাঁর বাবা সহিদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাঁরা সাড়া দেননি।
দখলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে রিট
পুকুরটি দখলমুক্ত করে তা সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। পাশাপাশি রিটে পুকুর দখল করে মার্কেট ও কাউন্সিলর অফিস নির্মাণে নিষেধাজ্ঞাসহ দখলের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
গতকাল মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এ রিটটি করেন। সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী মো. ছারওয়ার আহাদ চৌধুরী ও রিপন বাড়ৈর পক্ষে এ রিটটি দায়ের করা হয়। রিটে স্থানীয় সরকার সচিব, পরিবেশ সচিব, রাজউক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। রিটের পর মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের জানান, চলতি সপ্তাহে রিটটি হাইকোর্টের এখতিয়ারসম্পন্ন বেঞ্চে শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে। চলতি সপ্তাহেই শুনানি হতে পারে।
মন্তব্য করুন