- রাজধানী
- ম্যুরালসর্বস্ব ‘অখণ্ড ভারত’ শিশুসুলভ ও অবাস্তব
প্রতিবেশী
ম্যুরালসর্বস্ব ‘অখণ্ড ভারত’ শিশুসুলভ ও অবাস্তব

গত ২ জুন প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছিল– বেঙ্গালুরু কারাগার থেকে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত পলাশ ও শুক্লা অধিকারী দম্পতির ১০ মাস পর মুক্তি মিলেছে। স্থানীয় জামিনদার না পাওয়ায় জামিনের পরও তাঁদের অতিরিক্ত এক মাস কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
একই দিনে প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল– নতুন পার্লামেন্ট ভবনে অঙ্কিত ‘অখণ্ড ভারত’ ম্যুরাল নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন নেপালের রাজনৈতিক নেতারা। সেখানে বলা হয়, ‘অখণ্ড ভারত’ হিন্দুত্ববাদ অনুপ্রাণিত ধারণা। তাঁদের শঙ্কা, এর ফলে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
প্রসঙ্গত আমিও একটি বই লিখছি; শিরোনাম– ‘দ্য কেস ফর অখণ্ড ভারত’। সেখানে আমি দুটি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রথমত– ভারতীয়রা, বিশেষ করে বিজেপির সমর্থক হিন্দুরা যদি সত্যিই দক্ষিণ এশিয়াকে একত্র করতে চায়, তবে তারা চিত্রাঙ্কন ও ম্যুরাল ছাড়া অন্য চেষ্টা করছে না কেন? দ্বিতীয়ত, ‘অখণ্ড ভারত’-এর জন্য আসলে কী লাগবে?
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর সহজ। বিজেপি এবং হিন্দুদের মধ্যে যারা বিজেপির সমর্থক, তারা আসলে দক্ষিণ এশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করতে চায় না। তারা চায় ‘প্রজা’ সংবলিত সাম্রাজ্য। বিজেপি আসলে জমি চায়; মানুষ চায় না। বিষয়টি বুঝতে হলে কাশ্মীরের দিকে তাকাতে হবে।
ধর্মান্ধতা নিঃসন্দেহে বিরক্তিকর, তবে দ্বিতীয় প্রশ্নটি কৌতূহলোদ্দীপক। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের আসলে কীসের মাধ্যমে একত্র করা যেতে পারে? অস্ত্রের মাধ্যমে সম্ভব নয়। মানচিত্রে যা দেখা যায়, তার চেয়েও কাশ্মীরের বাস্তবতা ভিন্ন।
স্কুলের মানচিত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। ফলে প্রকৃত অবস্থা তারা বুঝতে পারে না এবং প্রতিবেশীদের নিয়ে তারা আতঙ্কিত। তারা জানে না যে, উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমরা চাইলেও সামর্থ্যের অভাবে তাদের আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারি না।
আমরা একটা পর্যায় পর্যন্ত নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশকে ভয় দেখাতে পারি। কিন্তু মানচিত্র এবং বক্তৃতায় উচ্চারণ করা ছাড়া তাদের ভূমি আমাদের সঙ্গে একত্র করার দাবি তোলার কোনো বৈধতা নেই। তবে অন্য একটি উপায় আছে, যা বিবেচনা করা হচ্ছে না। আমার বইটি ঠিক এ সম্পর্কেই। প্রভাবশালী শক্তি, বৃহত্তম অর্থনীতি, পুরোনো গণতন্ত্র এবং সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে ভারত তার প্রতিবেশীদের কাছে সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজনীতির বাইরে অন্য বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন প্রথম গঠিত হয়েছিল, তখন তাদের অভিন্ন মুদ্রা কিংবা পার্লামেন্ট ছিল না। তারা সংযুক্ত হয়েছিল তাদের স্টিল ও কয়লাশিল্পের মাধ্যমে। কারণ এ দুটি উপকরণ তাদের অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনী শক্তিশালী করেছিল। প্রথ বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ওপর জবরদস্তি এবং তারপর ঐকমত্যের মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে। মনে রাখতে হবে, একই ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও তারা ১৯১৪ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে মাত্র তিন দশকে বিশ্বের অন্য যে কোনো অংশের তুলনায় একে অপরকে বেশি হত্যা করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দক্ষিণ এশিয়াতেও অভিন্ন মুদ্রা সম্ভব? দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রার বাইরে অন্য কোন বিষয়গুলো আমাদের পরস্পরকে সংযুক্ত করতে পারে? এর মধ্যে একটি হতে পারে পরিবহন; অর্থাৎ সড়ক, রেল ও আকাশপথে অবাধ যোগাযোগ। পরস্পরের মধ্যকার যাতায়াতও হতে হবে অবাধ। তার মানে, কলকাতা থেকে ঢাকায় কিংবা লাহোর থেকে শিমলা ভিসা ছাড়াই যেতে পারবে। এই ব্যবস্থা করা কঠিন নয়। কলমের এক খোঁচাতেই এটা হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রতিবেশী মানেই শত্রু– এ ধারণাটি।
ভিসামুক্ত চলাচল নিশ্চিত করার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেটা করেছিল, সেটা হলো– পণ্য ও পরিষেবার চলাচল সহজ করা। এর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতি একত্রিত হয়েছে এবং সব দেশকে উপকৃত করেছে। এখানেও এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিশেষত যারা যে জিনিস উৎপাদন করে না, তারা অন্যদের থেকে পাবে। স্থানীয়ভাবে অন্যান্য দেশ যা উৎপাদন করতে পারবে না, তার চেয়ে বেশি দক্ষতার সঙ্গে কম খরচে গাড়ি, দুই চাকার গাড়ি, পেট্রোল, সফটওয়্যার, বাদ্যযন্ত্র, বই, নার্স, প্রকৌশল ও ওষুধসামগ্রী উৎপাদন করে অন্যান্য দেশে পাঠাতে পারে। এটা না করা মানে ভারতীয়দের সুযোগ কমানো এবং ভারতের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা খাটো করা।
পরবর্তী সময়ে এই সহযোগিতা আরও নানা দিকে সম্প্রসারিত হতে পারে, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন করেছে। কিন্তু তার বদলে নতুন পার্লামেন্ট ভবনে যে ম্যুরাল অঙ্কন করা হলো, সেটা নেপাল ও অন্য প্রতিবেশীদের দূরে ঠেলে দেবে। বস্তুত ভারতীয় নতুন পার্লামেন্ট ভবনের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে যা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা শিশুসুলভ ও অবাস্তব। আর যাই হোক, ম্যুরালের মাধ্যমে ‘অখণ্ড ভারত’ আসবে না।
আকর প্যাটেল: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারতের চেয়ারম্যান; ডেকান ক্রনিকল থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন