- রাজধানী
- ঘরে সাজানো বই খেলনা, নেই শুধু শায়েন-শাহিল
বিষক্রিয়ায় দুই ভাইয়ের মৃত্যু
ঘরে সাজানো বই খেলনা, নেই শুধু শায়েন-শাহিল

স্কুলে এভাবেই স্মরণ করা হলো দুই ভাইকে
দীর্ঘদিন উত্তরায় ভাড়া বাসায় ছিল ব্যবসায়ী মোবারক হোসেনের পরিবার। অনেক স্বপ্ন ছিল, নিজেদের ফ্ল্যাটে উঠবেন। সেই স্বপ্ন পূরণে চার বছর আগে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লকে ফ্ল্যাট বুকিং দেন। ২২ মে সেই ফ্ল্যাটে দুই ছেলে শাহিল মোবারত জায়ান (৯), বড় ছেলে শায়েন মোবারত জাহিন (১৫) ও মেয়ে শাহরিন মোবারত জায়মা (১৪) এবং স্ত্রী শারমিন জাহানকে নিয়ে ওঠেন। ২৮ জুন ছোট ছেলে জায়ানের ১০ বছর পূর্ণ হবে। নতুন বাসায় বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে বড় পার্টি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মোবারক হোসেন। ছেলেও দিন গুনত– কবে তার জন্মদিন আসবে; বন্ধু-স্বজনরা আসবে। মর্মান্তিক ঘটনায় দুই সন্তানকে হারানোর পর নতুন ফ্ল্যাটে বিষাদের ছায়া।
দুই শিশুর খালা রওশন জাহান বললেন, এত ভদ্র ছেলে আর হয় না। স্কুলের সবাই সান্ত্বনা দিতে আসছে। এই শোক কীভাবে সইবে মা-বাবা! পুরো ঘরের কোথায় কী থাকবে, সব ডেকোরেশনের কাজটি জাহিন করেছিল। নতুন বাসায় ভাইয়ের প্রথম জন্মদিন হবে– এ নিয়ে কত প্ল্যান ছিল তার। প্রথমে ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে ও বলছিল– ‘এটা সত্যি হতে পারে না। এটা ফেয়ার নয়।’ এর কয়েক ঘণ্টা পর সে নিজেই চলে গেল। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা যেন কারও জীবনে না ঘটে।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় ছিটানো পোকামাকড়ের ওষুধের বিষক্রিয়ায় দুই ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামের পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানের এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত সোমবার রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সকালে টিটুকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে ভাটারা থানা পুলিশ। এ সময় আদালত তাঁর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
টিটু মোল্লা ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড নামে একটি পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানের কর্মী। পুলিশ জানায়, ডিসিএস অর্গানাইজেশন নামে ওই পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ভাটারার জে-ব্লকে। ঘটনার পর থেকে তালাবদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা উধাও। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তার টিটু দেড় বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন, ঘটনার দিন ডিসিএস অর্গানাইজেশনের দেওয়া ওষুধ তিনি ওই বাসায় স্প্রে করেছিলেন।
দুই শিশুর পারিবারিক সূত্র জানায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লকের ১০ নম্বর সড়কের ওই বাসায় তেলাপোকার উৎপাতের কারণে গত বৃহস্পতিবার পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন। পরদিন কর্মীরা বাসায় এসে বিকেল পৌনে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘরে ওষুধ স্প্রে করেন। এ সময় বাসার সদস্যরা বাইরে ছিলেন। পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা তাঁদের জানান, ওষুধ ছিটানোর পর তিন-চার ঘণ্টা বাসায় ঢোকা যাবে না। সে অনুযায়ী ওই দিন প্রায় ১০ ঘণ্টা পর রাত ৩টার দিকে মোবারক হোসেন তাঁর পরিবার নিয়ে বাসায় ঢোকেন।
মঙ্গলবারও ব্যবসায়ী মোবারকের বাসায় ছিল বিষাদের ছায়া। সন্তানদের খেলনাসহ নানা স্মৃতির কথা মনে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা-বাবা ও স্বজনরা। অশ্রুভেজা কণ্ঠে শিশুদের নানি শামসুন্নাহার বলছিলেন, এই শোক কী করে ভুলবে ওরা!
ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন জানান, ঘরে তেলাপোকা নিধনের কাজ করা হবে বলে দুই ছেলে ও মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের দুই কর্মী এসে বাসার কোনায় কোনায় টিস্যুর মধ্যে ট্যাবলেট রাখেন। তাঁদের কথামতো তিন ঘণ্টার বদলে ১০ ঘণ্টা পরই ঘরে ঢুকে তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ পান। বাসায় ঢোকার দু-তিন ঘণ্টা পরই স্ত্রী-সন্তানরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা বমি করা শুরু করেন। বাসায় ঢোকার আগে একটি দাওয়াত খেয়ে আসেন সবাই। ধারণা করা হচ্ছিল, দাওয়াতে ভারী খাওয়ার জন্য বমি হচ্ছে। এরপর দরজা-জানালা খুলে দেওয়া হয়। ঘরের কোনায় থাকা ওষুধ ফেলে দেওয়া হয়।
শিশুদের মা শারমিন বলছিলেন, তাঁর ছেলেমেয়েরা তেলাপোকা ভয় পেত। এ জন্য তেলাপোকা মারার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। কেন তেলাপোকা মারার ব্যবস্থা করলেন– এ আক্ষেপ এখন তাঁর।
এক পর্যায়ে অসুস্থ সবাই এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানেই শনিবার সকালে জায়ান মারা যায়। তার দাফন শেষ করে আসতে না আসতেই মোবারক হোসেনের বড় ছেলে জাহিন সোমবার সকালে মারা যায়। জাহিন ও জায়ান উত্তরার ডিপিএস এসটিএস স্কুলের শিক্ষার্থী। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার সমকালকে বলেন, ঘটনাটি শুনে মনে হচ্ছে, ওই বাসায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করা হয়েছে। এটা অতিমাত্রার বিষাক্ত কীটনাশক। মানুষ বসবাস করেন এমন কোনো স্থানে এর ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সাধারণত গুদামজাত পণ্য পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের লোকজনই অনেক রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানেন না। তেলাপোকা মারতে স্প্রে, জেলসহ অনেক ধরনের জিনিসত্র পাওয়া যায়।
মন্তব্য করুন