ঢাকা ওয়াসা এত দিন গলা ফাটিয়েছে– চাহিদার চেয়েও তাদের পানির উৎপাদন ক্ষমতা বেশি। কয়েক দিনের তাপদাহ আর লোডশেডিংয়ের বাড়াবাড়িতেই এখন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানেরও নরম সুর! গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি রাজধানীবাসীকে এই সময়ে কম পানি ব্যবহারের সবক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখন সরাসরি রানিং পানি ব্যবহার না করে পাত্রে নিয়ে ব্যবহার করুন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে পানির চাহিদা কী পরিমাণ বাড়ে, সে ধারণা ওয়াসার নেই। তা না হলে এত অল্পতেই পানি ব্যবস্থাপনায় হযবরল পরিস্থিতি হবে কেন? সংস্থাটির তত্ত্বাবধানে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প; এত দিনেও কেন তারা পাম্পগুলোতে জেনারেটর নিশ্চিত করতে পারল না। এ দায়ভার এককভাবে ওয়াসাকেই নিতে হবে।
ঢাকা ওয়াসার দাবি, প্রতিদিন গড়ে ২৮০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করেছে তারা। গত এক সপ্তাহে ৯১৪ পাম্পের মধ্যে জেনারেটরহীন ১৫৮টি বিদ্যুৎ বিভ্রাটজনিত কারণে ২৭৫ ঘণ্টা বন্ধ থেকেছে। ওয়াসার হিসাবে প্রতিদিন দেড় হাজার গাড়ি পানির চাহিদা জমা পড়লেও ৭৫০টির বেশি সরবরাহ করতে পারছে না তারা। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার গাড়ি পানির চাহিদা থাকে। এদিকে ওয়াসার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, প্রতিদিন যদি একজন মানুষের ১৩০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়, সে হিসাবে রাজধানীতে দুই কোটি লোকের জন্য ২৬০ কোটি লিটার পানি লাগে। তবে বাস্তবে একজন মানুষ প্রতিদিন ১৩০ লিটার পানি ব্যবহার করছেন না। আর ওয়াসার প্রকৃত উৎপাদন যদি দৈনিক ২৮০ কোটি লিটার হয়, কোনোভাবেই রাজধানীতে পানি সংকট থাকার কথা নয়। ওয়াসা যে হিসাব দেয় তা কাগুজে, এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।

কারণ হিসেবে ওয়াসারই এক প্রকৌশলী জানান, একটি প্লান্ট বা পাম্প স্থাপনের সময় যে পরিমাণ পানি ওঠে, সেটাই হিসাব করা হয়। প্রতিনিয়ত পাম্প বা প্লান্টের উৎপাদন ক্ষমতা কমে। কাজেই ওয়াসা যে হিসাব দেয়, ওই পরিমাণ পানি তারা কখনোই উৎপাদন করতে পারে না।

প্রতিদিন লোকসান সাড়ে ৩ কোটি টাকা
প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা থেকে পানি এনে রাজধানীতে সরবরাহের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা ওয়াসা। সেখান থেকে প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে ২০ কোটি লিটারের মতো। কারণ, ওই প্লান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ঠিক থাকলেও ওই পানি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো পাইপলাইন এত দিনেও বসাতে পারেনি ওয়াসা। এ ছাড়া সাভারের ভাকুর্তা প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ২৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা থাকলেও এর অর্ধেকও মিলছে না। দুই প্রকল্প থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম পাওয়া যাচ্ছে ৩৩ কোটি লিটার পানি। আবাসিক পর্যায়ে এক ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দর ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। এ হিসাবে ৩৩ কোটি লিটার পানির দাম পড়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা। প্রতিদিনই এই টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ওয়াসা।
 
যে কারণে পানি সংকট
শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর থেকেই রাজধানীতে পানি সংকট দেখা দেয়। মাঝেমধ্যে সে সংকটে ঘি ঢালে লোডশেডিং। কারণ, ওয়াসার সব পাম্পে জেনারেটর নেই। বিদ্যুৎ গেলেই সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। যেগুলোতে জেনারেটর সংযোগ আছে, এর অনেকটিই আবার বিকল। সচলগুলোতেও সরবরাহ হয় না প্রয়োজনীয় ডিজেল। অনেক সময় যেটুকু ডিজেল দেওয়া হয়, এর সিংহভাগ পাম্প অপারেটররা চুরি করে বাইরে বিক্রি করে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিদ্যুতের ওপরই পানির উৎপাদন নির্ভর করে। দীর্ঘদিনেও প্রতিটি পাম্পে জেনারেটর ও প্রয়োজনীয় জ্বালানি নিশ্চিত করতে পারেনি ওয়াসা। এ ছাড়া বিকল হয়ে আছে অনেক পাম্প। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক পাম্পে পানি ওঠে না। সচলগুলোও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে না। ওয়াসা কাগজে-কলমে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পানি উৎপাদন হচ্ছে বলে হিসাব দেখায়। ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই বলেন, ওয়াসা পানি উৎপাদনের যে হিসাব দেয়, তা শুভঙ্করের ফাঁকি।

পানির কষ্টে নগরবাসী
বেসরকারি চাকরিজীবী মো. ওয়াকিল আহমেদের বাসা রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ায়। ৪৪২/১ শাপলা সরণির তাঁর বাসায় পানি নেই পাঁচ দিন। এ কারণে তিন দিন আগে স্ত্রী-সন্তানকে পাঠিয়েছেন খিলগাঁওয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় । নিজে একা থাকছেন বাসায়। এর মধ্যে দু’দিন গোসল করেননি ওয়াকিল। জারের পানি কিনে শৌচকার্য সেরেছেন। এই গরমে গোসল না করে থাকাটাও তাঁর জন্য কষ্টের। গতকাল সকালে তিনি এক সহকর্মীকে ফোন দিয়ে তাঁর বাসায় পানি আছে কিনা জানতে চান। পরে সহকর্মীর বাসায় গিয়ে গোসল সেরে অফিসের পথে ছোটেন।
ওয়াকিল বলেন, ঢাকা ওয়াসার মিরপুর অফিসে ফোনে যোগাযোগ করে পানি চাইলেও চার দিনে পাইনি। এভাবে তো আর চলে না। কী কষ্টে আছি বলে শেষ করা যাবে না।
পশ্চিম শেওড়াপাড়া বাড়ি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ভূঁইয়া বলেন, বেশ কিছুদিন হলো এলাকাবাসী তীব্র পানির কষ্টে আছেন। দু-একটি বাসাবাড়িতে রাতে অল্পস্বল্প পানি পাওয়া গেলেও সেটাকে পানি বলা যায় না। যেন দুর্গন্ধযুক্ত ঘন তরল পদার্থ! বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসী স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ুন রশিদ জনির কাছে গিয়েছিলেন। কাউন্সিলর ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। প্রয়োজনে কাউন্সিলরও ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে বলে দেবেন বলে তাঁদের সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছেন।

এমন দুর্দশা শুধু শেওড়াপাড়ায় নয়; রাজধানীর অনেক স্থানেই চলছে পানির হাহাকার। নগরবাসী গাড়িতে করে পানি সরবরাহের অনুরোধ করেও কোনো কিনারা পাচ্ছেন না।
গুলশান ২ নম্বরের ৮১ নম্বর রোডের ১০/এফ হোল্ডিংয়ের বাসিন্দা সাঈদ জানান, পাঁচ দিন ধরে পানি মিলছে না। অনেক তদবির করে তিন দিন অপেক্ষার পর এক গাড়ি পানি ওয়াসা থেকে পেয়েছিলেন। পরে তিনি পানির জন্য মহাখালী কার্যালয়ে যান। সেখানে পানির কথা বললে ওই অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।
উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ৭ নম্বর হাউসের বাড়ি মালিক রেজা রায়হান বলেন, এক গাড়ি পানির জন্য ওয়াসায় চাহিদাপত্র দিয়েছেন। মঙ্গলবার সিরিয়াল দিলেও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি পৌঁছেনি। বাসার অবস্থা কারবালার মতো হয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ওয়াসা যে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন প্রকল্প করল, বিভিন্ন সময় বলেছে চাহিদার চেয়ে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি, তাহলে এখন একটু লোডশেডিংয়েই কেন পানির হাহাকার।

ওয়াসা যা বলছে
গতকাল ওয়াসা ভবনে পছন্দের কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে মতবিনিময়কালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান রাজধানীতে পানি সংকটের কথা স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে ঢাকা ওয়াসার ১০ জোনের মধ্যে ৫টিতে পানি সরবরাহে সংকট হচ্ছে। বিদ্যুৎ না পাওয়ায় পাম্পগুলো সার্বক্ষণিক চালানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় মানুষকে কম পানি ব্যবহারের অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘সংকট বাড়লে প্রয়োজনে রেশনিংয়ের মাধ্যমে এক এলাকায় পানি বন্ধ রেখে অন্য এলাকায় দেওয়া হবে। যেসব এলাকায় পানির সংকট হচ্ছে, সেখানে ৪৮টি গাড়ি ও ১৭টি ট্রলির মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য গাড়িতেও পানি ভরতে সমস্যা হচ্ছে।’

সাংবাদিক সংগঠনের নিন্দা
বরাবরের মতো পছন্দসই গুটিকয়েক সংবাদকর্মীকে নিয়ে তাকসিম এ খানের নামসর্বস্ব সংবাদ সম্মেলন করার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম, বাংলাদেশ। সংগঠনের সভাপতি অমিতোষ পাল ও সম্পাদক সম্পাদক সোহেল মামুন এক বিবৃতিতে বলেন, এর আগেও এমডি তাকসিম এ খান একই কাজ করেছেন। এর মাধ্যমে এমডির অসাধুতা ও নৈতিক স্খলনের চিত্রই প্রকাশ পায়। ওয়াসা একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সেখানে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত থাকা উচিত। অথচ ওয়াসায় সাংবাদিকদের প্রবেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন এমডি তাকসিম।


বিষয় : পানি উৎপাদনে ঢাকা ওয়াসা ‘কাগুজে বাঘ’ ঢাকা ওয়াসা

মন্তব্য করুন