- রাজধানী
- ব্যস্ত সড়কে গুলি, ধাওয়া করে হামলা
ব্যস্ত সড়কে গুলি, ধাওয়া করে হামলা

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার ব্যস্ত সড়ক। সোমবার রাত পৌনে ১০টা। বিজি প্রেস থেকে সামান্য দূরত্বে একটি প্রাইভেটকারকে হঠাৎ ঘেরাও করে ফেলে চারটি মোটরসাইকেলে থাকা সাত-আট অস্ত্রধারী যুবক। প্রাইভেটকারে যাত্রী হিসেবে ছিলেন ঢাকার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুন, তাঁর দুই সহযোগী খোকন ও মিঠু। অস্ত্রধারীদের দেখেই মামুন প্রাইভেটকার থেকে নেমে দৌড়ে বিজি প্রেসের পাশের গলিতে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় হামলাকারীরা গলির ভেতরে মামুনকে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে তারা মামুনকে কোপাতে থাকে। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলিও চালানো হয়। সন্ত্রাসীদের ওই গুলি গিয়ে লাগে রাস্তার উল্টো পাশ দিয়ে যেতে থাকা মোটরসাইকেল আরোহী আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। আহত হন আরিফুল হক ইমন নামের আরেক পথচারীও।
জানা গেছে, আইনজীবী ভুবন ভাড়ার মোটরসাইকেলে মিরপুর থেকে তাঁর ফকিরাপুলের বাসায় ফিরছিলেন। তিনি বর্তমানে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, সন্ত্রাসী মামুনের ওপর এক থেকে দেড় মিনিটের ওই হামলায় কারাগারে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা অংশ নেয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের শত্রুতার জেরে হত্যার উদ্দেশ্যেই মামুনের ওপর হামলা চালায় তারা। মামুন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই শহীদ সাঈদ আহমেদ টিপু ও চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি। সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় মামুন ২৬ বছর জেল খেটে তিন মাস আগে জামিনে মুক্তি পান। তার পর থেকে তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল ইমন গ্রুপ।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, ঘটনার পর মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জামিনে বের হওয়ার পর ১২ সেপ্টেম্বর আদালত এলাকায় মামুনের সঙ্গে সন্ত্রাসী ইমনের সাক্ষাৎ হয়েছিল। হাজিরা দিতে তারা আদালতে যান। তখন আদালত এলাকায় ইমন হাতের ইশারায় মামুনকে গুলি করার মতো দেখিয়ে মেরে ফেলার বার্তা দেন। একসময় তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এখন আলাদা গ্রুপ করা নিয়ে মামুন ও ইমনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।
হামলাস্থলের আশপাশের বিভিন্ন সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, রুপালি রঙের একটি প্রাইভেটকার মগবাজারের দিক থেকে বিজয় সরণির দিকে যাচ্ছিল। এ সময় দ্রুতগতির দুটি মোটরসাইকেল গাড়িটির পিছু নেয়। একটি মোটরসাইকেল গাড়ির আগে এসে গতিরোধ করে, অন্যটি দাঁড়ায় পেছনে। এ সময় মামুন গাড়ি থেকে নেমে বিজি প্রেসের সামনে দিয়ে মগবাজারের দিকে দৌড় দেন। কিন্তু কালো রঙের শার্ট গায়ে এক ব্যক্তি মামুনের পেছন পেছন দৌড়ে তাঁকে ধারালো কিছু দিয়ে কোপ দেয়। পরে পাম্পের সামনে পার্ক করে রাখা একটি ট্রাকের সামনে আরও দুটি মোটরসাইকেলে চার-পাঁচ ব্যক্তি মামুনকে সামনে থেকে গতিরোধ করে এবং এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। প্রায় ৮ থেকে ১০ সেকেন্ড কুপিয়ে মামুনকে ফেলে রেখে সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেলে মহাখালীর দিকে চলে যায়। তবে তারা বিজয় সরণি নাকি আবার ঘুরে মগবাজারের দিকে চলে যায়, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পুলিশ জানায়, হামলার সময় মামুনের সঙ্গে গাড়িতে থাকা তাঁর সহযোগী খোকন থানায় এসে বিষয়টি জানান। কিন্তু ঘটনার পর থেকে মিঠু পলাতক। রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন মামুন। খোকনকে পুলিশ হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ ছাড়া মামুনও নজরদারিতে রয়েছেন। তারা চার-পাঁচ দিন ধরে ভাড়ায় চালিত ওই গাড়িতে করে চলাফেরা করছিলেন। হামলার সময় মামুন ও তাঁর সহযোগীরা কোনো পাল্টা গুলি ছোড়া বা প্রতিরোধ করেননি। ঘটনার সময় সন্ত্রাসীরা মামুনের সহযোগীদের ওপরও কোনো হামলা করেনি।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তারা একসঙ্গে দীর্ঘদিন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জোশেফের হয়ে কাজ করেছেন। ইমন-মামুন দু’জনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি। ওই মামলায় ইমন কারাগারে থাকলেও তিন মাস আগে জামিনে বের হয়েছেন মামুন। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই দু’জনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। সেই বিরোধের জেরে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা মামুনেরও।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, জিগাতলা এলাকার স্থানীয় ইমন। ওই এলাকায় সবাই তাঁকে ‘ক্যাপ্টেন’ নামে চেনেন। বর্তমানে হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার বেশ কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইমনের অনুসারী। এ ছাড়া জেল থেকেই ইমন ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। আর মামুন ১৯৯৮-২০০০ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মুহসীন ও জহুরুল হলে থাকতেন। তবে তিনি ঢাবির ছাত্র ছিলেন না। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে মামুনের জামিন পাওয়া নিয়েও আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া গত সোমবার আরেক সন্ত্রাসী রসুও জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
একটি সূত্র জানায়, হামলায় আহত হয়ে রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মামুনকে বলতে শোনা যায়, স্যার, চিকিৎসা শেষে কে আমার ওপরে হামলা করেছে, খুঁজে বের করব। এ সময় হাসপাতালে ছুটে আসেন অনুসারীরা। তারা সারারাত মামুনকে পাহারা দিয়েছেন। মামুনের অনুসারীদেরও উগ্র মেজাজে দেখা গেছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা ছাড়াও মামুন আলোচিত হিমেল হত্যা, রহিম হত্যা, আদালত চত্বরে মোর্শেদ হত্যা মামলার আসামি। এর মধ্যে মোর্শেদ খুনের মামলায় মামুনের ফাঁসির আদেশ হয়। পরে উচ্চ আদালত থেকে তিনি খালাস পান। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার শমসেরাবাদ গ্রামের এস এম ইকবালের ছেলে মামুন। তাঁর চাচাতো ভগ্নিপতি বিএনপি নেতা বরকত উল্লাহ বুলু। এ ছাড়া তাঁর দু’জন প্রভাবশালী আত্মীয় রয়েছেন।
গুলিতে আহত হওয়ার পর আইনজীবী ভুবনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান মোটরসাইকেলচালক মো. শামীম। তিনি জানান, রাতে মিরপুর শেওড়াপাড়া থেকে তাঁর ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে আরামবাগ এলাকার বাসায় ফিরছিলেন ভুবন। পথে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল বিজি প্রেসের সামনে দুটি বিকট শব্দ হয়। পরে দেখেন, মোটরসাইকেলে থাকা ভুবন হেলে পড়েছেন। মাথা ধরে সোজা করে দেখেন রক্ত ঝরছে। সেখান থেকে তাঁকে অন্য একটি গাড়িতে করে দ্রুত শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই সাহিদুল ইসলামসহ তাঁকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভুবনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী জয়শ্রী রানী জানান, তাদের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলায়। গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেডের লিগ্যাল অ্যাডভাইজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন ভুবন। মতিঝিলের আরামবাগ এলাকার একটি মেসে ভাড়া থাকতেন তিনি। এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন। রাতে পুলিশের মাধ্যমে ভুবন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে মুগদা থেকে তারা ঢামেক হাসপাতালে আসেন। বর্তমানে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন ভুবন।
এদিকে ঘটনার পর তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের কয়েকটি ইউনিট বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে। এ ছাড়া ডিবি পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে কাজ করছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এরই মধ্যে তারা মহাখালী, মগবাজার, বিজয় সরণিসহ আশপাশের এলাকার সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
গতকাল দুপুরে মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশিদ জানান, জেলে থাকা অবস্থায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন হুমকি দিয়েছিল মামুনকে। ইমনের লোকজন মামুনের ওপর হামলা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্তে সবকিছুই আসবে।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, ওই রাতে মগবাজার এলাকার পিয়াসী বার থেকে বের হন মামুন, খোকন ও মিঠু। প্রাইভেটকারে করে তারা মামুনের ধানমন্ডি শুক্রাবাদ তল্লাবাগ এলাকার বাসায় ফিরছিলেন। হামলার ঘটনায় এখনও মামলা করেনি কোনো পক্ষ। তবে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
মন্তব্য করুন