ঢাকা সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

শূন্য ভুবনে স্ত্রী-কন্যার হাহাকার

শূন্য ভুবনে স্ত্রী-কন্যার হাহাকার

এমন মৃত্যুতে সান্ত্বনা হয় না। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের গালে সন্তানের মমতামাখা চুমু। সোমবার ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে -সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

স্বামীর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় গতকাল সোমবার সকালেও হাসপাতালের সিঁড়িতে বসেছিলেন রত্না রানী শীল। তখনও আশা ছিল, তাঁর জ্ঞান ফিরবে; এরপর সুস্থ হয়ে স্ত্রী-সন্তানের কাছে ফিরে আসবেন। কিন্তু সাড়ে ১০টার দিকে এক চিকিৎসক এসে রত্নাকে বলেন, ‘আপনার স্বামী আর নেই।’ এই সংবাদে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন তিনি। ওই চিকিৎসককে বলেন, ‘না স্যার, ভুবন আমাকে রেখে মরতে পারে না। আপনারা আরেকটু চেষ্টা করুন, ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করুন।

ও চলে গেলে এই শূন্য পৃথিবীতে আমরা কী নিয়ে বেঁচে থাকব?’

 রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে বিদ্ধ হওয়ার আট দিন পর অবশেষে স্ত্রী-সন্তানের ভুবন শূন্য করে চলে গেছেন ভুবন চন্দ্র শীল। সেই সঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে একটি সুখের সংসার। তাঁর এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন রত্না রানী শীল। কারও সান্ত্বনায় মন মানছে না তাদের একমাত্র মেয়ে ভূমিকা শীলের। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বারিধারার গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেডের অফিস থেকে মতিঝিলের আরামবাগের মেসে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন। এদিন রাতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের গাড়ি ঘিরে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। এ সময় মামুন গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। তাদের ছোড়া গুলিই মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন ও পথচারী আরিফুল হক ইমনকে বিদ্ধ করে। ঘটনার পর থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালের লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি। স্বামীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনেই ঢাকায় চলে আসেন নোয়াখালীর অরুণচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা রত্না। সঙ্গে ছিলেন মেয়ে ভূমিকা। এক সপ্তাহ উৎকণ্ঠায় কাটানোর পর তারা ভুবনের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর পপুলার হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় সিসিইউর সামনে মানুষের ভিড় দেখা যায়। তাদের একজন বলছিলেন, তেজগাঁওয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত লোকটা মারা গেছে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ভুবনের শ্যালক তাপস মজুমদার। তিনি সবাইকে অনুরোধ করেন, ‘ভাই একটু আস্তে কথা বলুন। আমার বোনের অবস্থাও বেশি ভালো না।’ ভুবনের মৃত্যুর খবর শুনে ততক্ষণে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন তাঁর আত্মীয়-স্বজনসহ সহকর্মীরা। তাদের কেউ কেউ রত্নাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ সময় মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছিলেন ভূমিকা শীল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয় ঘটনার আগের দিন রাত ১২টায়। বাবা বলছিল, কয়েক দিন পরেই বাড়ি আসব। তোমার জন্য কী আনতে হবে মা? মা-বাবার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় আমি কাকে বেশি ভালোবাসি, সেটা নিয়ে তারা মাঝেমধ্যেই বাজি ধরত। আমি বাবাকেই বেশি ভালোবাসি বলতেই মা মন খারাপ করত। আর বাবার মুখ আনন্দে ঝলমল করত। আবার বাবা ঢাকায় চলে গেলে মায়ের মান ভাঙানোর চেষ্টা করতাম। এটা নিয়ে ফোনে মা-বাবার মধ্যে খুনসুটি হতো। বাবা তো আমাদের ফেলে চিরতরে চলে গেল। এখন কে আমাকে মা বলে ডাকবে? কে জানতে চাইবে আমি কাকে বেশি ভালোবাসি?’

ভূমিকা আরও বলেন, ‘বাবা চাইতেন আমি চিকিৎসক হই। কিন্তু আমার ইচ্ছা ব্যবসায়ী হওয়া। পরে আমার ইচ্ছাকেই মেনে নেন বাবা। এ নিয়ে বাবা-মেয়ে মিলে পরিকল্পনা করতাম, কোন ব্যবসা করলে ভালো হয়।’

হাসপাতালে ছুটে আসা ভুবনের সহকর্মীদের সঙ্গে রত্না বলছিলেন, ‘ভুবন খুব শখ করে আমাকে একটি আংটি বানিয়ে দিয়েছিল। ওর চিকিৎসার জন্য সেটাও বিক্রি করে দিয়েছি। তারপরও ওকে বাঁচাতে পারলাম না। আমার মেয়েটা এত অভাগা যেন ওর ছোট ছোট স্বপ্নও আর পূরণ হলো না। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে বিভিন্ন তীর্থস্থানে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল বাবা-মেয়ের। এখন তো সবই শেষ।’

এ সময় স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ‘কে গুলি করেছে জানি না। আমার স্বামীকে তো আর ফিরে পাব না। কিন্তু ওর খুনিদের বিচারটা যেন হয়। এভাবে আর কোনো সন্তানকে যেন পিতৃহারা হতে না হয়।’

দুপুর ২টার দিকে ময়নাতদন্তের জন্য ভুবনের মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে নেওয়া হয়। ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফেনীর পরশুরামের উদ্দেশে রওনা হন পরিবারের সদস্যরা। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য হওয়ার কথা রয়েছে।

ভুবনের স্ত্রীর বড় ভাই পলাশ মজুমদার বলেন, ‘নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ভুবন। অথচ সরকারের কোনো সংস্থা তাঁর খোঁজ নেয়নি। কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। এমন অবস্থা হলে পথে চলাচলকারী কেউ নিরাপদ নন। আমার ভাগনি এখনও ছোট, সরকার যেন তাঁর দায়িত্ব নেয়, কোনো একটি ব্যবস্থা করে। ভুবনের মা এখনও ছেলের মৃত্যুর খবর জানেন না। তিনি শুনলে তাকেও বাঁচানো যাবে কিনা সন্দেহ।’  

আরও পড়ুন