৬ ঘণ্টা রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ
অটোরিকশা চালকদের অবরোধে অচল ঢাকা
যানজটে স্থবির নগরী অসহনীয় দুর্ভোগ

ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে দিনভর বিক্ষোভ করেন চালকরা। কিছু স্থানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। দুপুরে মহাখালী থেকে তোলা -সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:৫৩ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ০৮:০১
সড়ক-রেলপথ অবরোধের ফলে দুই দিনের ব্যবধানে আবারও অসহনীয় যানজটে স্থবির ও দুর্বিষহ দিন দেখল রাজধানীবাসী। এবার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশের প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন চালকরা। গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তত ১২টি পয়েন্টে তাদের অবস্থানের ফলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা। সকাল ৯টা থেকে ৬ ঘণ্টা ধরে মূল অবস্থানটি ছিল মহাখালীতে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে রিকশাচালকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াও হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যানবাহন এবং আশপাশের কয়েকটি স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়। রাজারবাগে আন্দোলনকারীদের হামলায় আহত হন তিন পুলিশ সদস্য।
এদিকে অবরোধের কারণে ছয় ঘণ্টা ধরে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় দেখা দেয় শিডিউল বিপর্যয়। মহাখালী মোড় হয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সংলগ্ন পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে যানজট। এতে বিপাকে পড়েন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। বিশেষ করে অসুস্থ ও বয়স্করা অসহনীয় দুর্ভোগের শিকার হন।
এর আগে সোমবার সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে শিক্ষার্থীরা মহাখালীতে দিনভর সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করলে এমন দুর্ভোগের শিকার হন নগরবাসী।
ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপে গত মঙ্গলবার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই দিন রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় এক ছাত্রী নিহত হলে বিষয়টি নতুন মাত্রা পায়। তবে আদালতের নির্দেশের পরদিনই রাজধানীর দয়াগঞ্জ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে এর প্রতিবাদ জানান চালকরা। এদিন রিকশাচালকরা কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এলাকায়ও আন্দোলন করেন।
আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একই দাবিতে গতকাল সকাল ৯টার দিকে মহাখালী রেলগেট এলাকায় রেললাইনের ওপর অটোরিকশা ফেলে অবরোধ করেন চালকরা। এতে ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
সেই সঙ্গে মহাখালী মোড় দিয়ে বন্ধ হয় যান চলাচল। বিকেল ৩টার দিকে রিকশাচালকরা সড়ক থেকে সরার আগ পর্যন্ত মহাখালী হয়ে কোনো যান চলতে পারেনি। ফলে মগবাজার থেকে মহাখালী হয়ে উত্তরা এবং একইভাবে উত্তরা থেকে মহাখালী হয়ে মগবাজার ও ফার্মগেটের দিকে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এ সময় সড়কে দেখা যায় যানবাহনের দীর্ঘ চাপ। এর প্রভাব পড়ে গুলশান, বনানী, বাড্ডা এলাকায়ও। অনেকেই যানবাহন থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন।
সরেজমিন দেখা যায়, গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত রিকশাচালকদের দখলে ছিল ঢাকা মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়ক। এর মধ্যে ছিল খিলগাঁও রেলগেট, রামপুরা, আগারগাঁও, কল্যাণপুর, গাবতলী, টেকনিক্যাল, মহাখালী, নাখালপাড়া, মোহাম্মদপুর, পল্লবী ও ডেমরা এলাকা। মহাখালীতে অবরোধের এক পর্যায়ে দুপুর ১টার দিকে রিকশাচালকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় চালকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। ভাঙচুর করা হয় বাহিনীর গাড়ি। আশপাশের কয়েকটি ভবনেও ভাঙচুর চালানো হয়। উচ্ছৃঙ্খল রিকশাচালকরা মহাখালীর এসকেএস শপিংমল, রাওয়া ক্লাব ও সিটি ব্যাংকের বুথ ভাঙচুর করেন। পরে বিকেল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
রাজধানীর তেজগাঁও থানার এসআই আমিনুর বলেন, আন্দোলনকারীদের রেললাইন থেকে সরিয়ে দিতে গেলে তারা সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের ধাওয়া দিয়ে এসকেএস শপিংমলের ভেতরে নিয়ে যায়। পরে তারা বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
এসকেএস শপিংমলের নিরাপত্তাকর্মী মো. ইমাম বলেন, রিকশাচালকরা রেললাইনের পাথর ছুড়ে শপিংমলের অধিকাংশ গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। তারা আমানা বিগ বাজার সুপারশপ ও একটি ক্যাফেতেও ভাঙচুর চালায়। সিটি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী মো. রাসেল বলেন, ইট ও পাথর দিয়ে এটিএম বুথে হামলা চালান রিকশাচালকরা। তখন আমি নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে যাই।
মহাখালী ও খিলগাঁও রেলগেট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কয়েক হাজার অটোরিকশাচালক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এতে কাকরাইল, পল্টন, মালিবাগ, রাজারবাগ, মগবাজারসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি, অটোরিকশা বন্ধ করলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে। তাই দাবি না মানা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
অটোরিকশা গ্যারেজের মালিকরা চালকদের রাস্তায় নামিয়েছেন বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেন। তবে কিছু রিকশাচালক জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অটোরিকশা কিনেছেন। এটা চালানো বন্ধ করলে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। কেউ কেউ বলেন, আপনারা ব্যাটারি উৎপাদন বন্ধ করে দেন– তাহলে সবাই আবার প্যাডেলচালিত রিকশায় ফিরে যাবে।
এদিকে দুপুরে রাজারবাগ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলা চালান রিকশাচালকরা। এতে এক সার্জেন্টসহ অন্তত তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আহতদের মাথায় ও হাতে ইটের আঘাত ছিল। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন।
একই দাবিতে গতকাল মিরপুর-১০, ১২ ও ১৩ নম্বর সেকশনেও খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন রিকশাচালকরা। তবে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের বাধায় তা বড় হয়নি। অবশ্য আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর ও বছিলায় রিকশাচালকরা অবরোধ করেন। এতে দুর্ভোগে পড়েন ওইসব এলাকার মানুষও।
‘প্রতিদিনই কেউ না কেউ জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে’
অটোরিকশাচালকদের আন্দোলনের প্রভাবে ঢাকার একাংশে যেমন ছিল যানজট, তেমনি কিছু এলাকায় দুপুরের দিকে গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল কম। এতে বিপাকে পড়েন নগরের বিভিন্ন গন্তব্য ও বিদেশগামী যাত্রীরা।
শান্তিনগর মোড়ে আঁখি আক্তার নামে এক শিক্ষার্থীকে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, গাজীপুর যাওয়ার জন্য দেড় ঘণ্টা ধরে বাসের অপেক্ষা করছি। পাঠাও সার্ভিসও অন্যদিনের তুলনায় দ্বিগুণ ভাড়া চাইছে। দেশের এই অবস্থা দেখার জন্য এত মানুষ জীবন দেয়নি। এখন প্রতিদিনই কেউ না কেউ জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।
স্ত্রীকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার পথে মহাখালীর রাস্তা বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন ধীরেন্দ্রনাথ। তিনি বলেন, অনেকদূর পর্যন্ত যানজট লেগে আছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে র্যাডিসন ব্লুর সামনে থেকে হেঁটে মহাখালী পর্যন্ত এলাম অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে। এখন জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত গিয়ে যদি কোনো গাড়ি পাই, তাহলে পঙ্গু হাসপাতালে যাব।
বৈশাখী পরিবহনের চালক আব্দুর রহমান বলেন, সাড়ে চার ঘণ্টা মহাখালী কাঁচাবাজারের সামনে আটকা পড়েছি। যাত্রীরা সব নেমে গেলেও বাসে বসে আছি। সারাদিনের ব্যবসা এখানেই শেষ। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে মালিকের জমা দিতে হবে।
ফার্মগেট থেকে মহাখালী পর্যন্ত হেঁটে আসা পথচারী রউফ ইসলাম বলেন, কয়েক ঘণ্টা যানজটে বসেছিলাম, পরে বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করেছি। ছোট ভাই বিদেশ থেকে আসছে। তাকে রিসিভ করতে যাচ্ছি; ছোট ভাই বিমানবন্দর পৌঁছে গেছে, আমি এখনও পৌঁছাতে পারিনি।
অটোরিকশা মূল সড়কে চলাচলের চেষ্টা করলে ব্যবস্থা: পুলিশ
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান সমকালকে বলেন, অটোরিকশার বিষয়ে আগের অবস্থায় থাকবে ট্রাফিক পুলিশ। যেসব যান যেখানে চলার কথা সেখানেই চলবে। যদি কেউ আইন ভেঙে মূল সড়কে অবৈধভাবে চলাচলের চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।