গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল
পিয়ন ঝাড়ুদার কম্পিউটার অপারেটর সবাই শিক্ষক!
শিক্ষক সংকট তীব্র, নেই প্রধান শিক্ষকও
ফাইল ছবি
সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫২ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:০২
তৃতীয় শ্রেণির ক্লাসে টেবিলের ওপরে বসে পা দোলাচ্ছিলেন তিনি। সামনে শিক্ষার্থীরা অশান্ত। কেউ তাঁর কথা শুনছে না। যে যার মতো করে দুষ্টুমিতে ব্যস্ত। শিক্ষকের এমন পাঠদানে সন্দেহ জাগে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যিনি ক্লাস নিচ্ছেন তিনি এ প্রতিষ্ঠানেরই পিয়ন (এমএলএসএস) সালমা আক্তার। পাশের আরেকটি কক্ষে একই সময়ে চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছিলেন বিদ্যালয়ের কম্পিউটর অপারেটর আব্দুর রহমান।
অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ ঘটনা খোদ রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের। শিক্ষক সংকট তীব্র থাকায় এই সরকারি হাই স্কুলে এখন ক্লাস নেন প্রতিষ্ঠানটির তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও। প্রতিষ্ঠানটির ঝাড়ুদার কৃষ্ণ চন্দ্র দাসকেও ক্লাসে পাঠানোর প্রমাণ মিলেছে।
সমকালের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক স্বীকার করেছেন কর্মচারীদের দিয়ে ক্লাস চালানোর বিষয়টি। তবে সরকারি চাকরি করায় তারা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
জানা যায়, এ বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন ৪৬ জন। থাকার কথা ৫৩ জন। প্রতিটি শ্রেণির আবার রয়েছে একাধিক শাখা। রয়েছে প্রভাতি ও দিবা শিফট। অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে বিদ্যালয়টিতে খোলা হয়েছে প্রাথমিক শাখা। সেখানে নেই কোনো শিক্ষক। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো সেখানে চালু করা হয়েছে কলেজ শাখাও। তবে কলেজেও নেই আলাদা কোনো শিক্ষক। এই ৪৬ শিক্ষক দিয়েই প্রাথমিক, হাই স্কুল ও কলেজের ক্লাস নিতে হয়। তিন ধাপের শিক্ষা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সবাইকে। এর মধ্যে কোনো শিক্ষক অসুস্থ বা সরকারি কাজে যেতে হলে রীতিমতো নাভিশ্বাস ওঠে বাকিদের।
তাই পাঠদান করাতে ক্লাসে পাঠানো হয় বিদ্যালয়ের পিয়ন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, কম্পিউটর অপারেটর, এমনকি বিদ্যালয়ে থাকা মসজিদটির ইমামকেও। দু-একদিন নয়, দিনের পর দিন এই ঘটনা ঘটে চলেছে। ঢাকা কলেজের পাশে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি এক সময় ফলাফলে দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করত। ক্রমে ক্রমে এখন শিক্ষার মানের দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি নেমে এসেছে তলানিতে।
এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যেও। পিয়ন, অফিস সহকারী দিয়ে ক্লাস নেওয়ার অভিযোগ যে মিথ্যা নয়, সেটা মেনে নিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠান প্রধানও। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আহসান উল্লাহ বলেন, আমাদের শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। এর বাইরে কেউ অসুস্থ হলে পাঠদান সমন্বয়ে খুব সমস্যা হয়। ক্লাসে শিক্ষক না থাকলে অনেক সময় ছাত্ররা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। তাই বাধ্য হয়ে ওদের (কর্মচারীদের) ক্লাসে পাঠানো হয়।
শিক্ষকের পরিবর্তে ঝাড়ুদারসহ অন্যদের দিয়ে এভাবে ক্লাস পরিচালনা করা ঠিক কিনা– এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কর্তাদের (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর) জানানো হয়েছে। হয়তো তারা শিগগিরই এখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক দেবেন।
গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ছাত্র সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে প্রাথমিক ও হাই স্কুল শাখায় ২ হাজার ৪০০ এবং বাকিরা কলেজের। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যমতে, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত থাকা দরকার ১:৩০। অথচ এ বিদ্যালয়ে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক মাত্র ৪৬ জন। একজন শিক্ষকের তুলনায় ছাত্র ৬৫ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাশের ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রশিক্ষণরত প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের পাঠদানের অনুশীলনের সুযোগ প্রদান করা।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণি ছাড়া দুটি করে সেকশন। শিক্ষক নিয়োগ হয় শুধু মাধ্যমিকের জন্য, অথচ ক্লাস ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। এক শিক্ষিকা বলেন, আমাদের প্রাথমিক চলছে আল্লাহর নামে। প্রাইমারি বন্ধের অনেকবার উদ্যোগ নিলেও অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ হয়নি। দুটি স্তরের পড়ানোর কৌশলও ভিন্ন। আমরা প্রাথমিকে পড়াতে পড়াতে নিজেদের মধ্যে মাধ্যমিকের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছি।
জানা যায়, রাজধানীর অন্যতম খ্যাতনামা বিদ্যালয় হওয়ায় এখানে শিক্ষার্থীদের ভর্তির চাপ অনেক বেশি। অথচ ভেতরে ভেতরে শিক্ষার মান কমছে। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। সর্বশেষ প্রধান শিক্ষক গত ৩০ অক্টোবর অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (পিআরএল) যান। দুই মাসের বেশি হলেও মাউশি এখনও কাউকে পদায়ন করেনি।
শিক্ষার্থীদের কয়েকজন সমকালকে বলেন, তাদের আইসিটি ও হিন্দু ধর্মের কোনো শিক্ষক নেই। ইসলাম ধর্মের শিক্ষক দিয়ে হিন্দু ধর্ম পড়ানো হয়। কলেজে দু’তিনজন শিক্ষক ভাড়া করে এনে মাঝে মাঝে ক্লাস করানো হয়।
বিষয়টি স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আহসান উল্লাহ বলেন, কলেজ শাখার ক্লাস চালিয়ে নিতে এমনটি করা হয়। তাদের বেতন নিয়ে বলেন, আমরা ম্যানেজ করে নিই।
এ বিষয়ে ল্যাবরেটরি স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, আমরা যাচাই করছি কোন কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট। বার্ষিক পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছি। ডিসেম্বরের মধ্যে ল্যাবরেটরি স্কুলসহ ঢাকার সব সরকারি স্কুলে শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণ করা হবে।