ঢাকা রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

স্বজনহারাদের অশ্রুধারায় প্লাবিত হলো বুড়িগঙ্গা

স্বজনহারাদের অশ্রুধারায় প্লাবিত হলো বুড়িগঙ্গা

লঞ্চডুবিতে নিহত হয়েছেন স্বজন। ঘটনাস্থলে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা- সমকাল

আতাউর রহমান

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ জুন ২০২০ | ১৫:৪৩

একজন নারী আর ১২ বছর বয়সী এক শিশুর লাশ একসঙ্গেই উদ্ধার করছিল ডুবুরি দল। বুড়িগঙ্গার মাঝনদীতে তখন উদ্ধারকর্মীদের মধ্যেও 'শিশু শিশু' বলে শোরগোল পড়ে যায়। দুপুরের পর আরও লাশের সঙ্গে ওই দুটি মরদেহও নেওয়া হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে। এ সময় স্বজনের আহাজারিতে মর্গের গুমট পরিবেশটা আরও ভারি হয়ে ওঠে। লোকজন বলাবলি করছিলেন- 'মা আর ছেলের লাশ।' পরিচয় শনাক্তের পর জানা গেল, নারীটি সুবর্ণা আক্তার আর শিশুটি তার ১২ বছর বয়সী ছেলে তামিম।

হতভাগ্য এই মা-ছেলের লাশ ঘিরে বিলাপ করছিলেন স্বজনরা। কাগজে স্বাক্ষরের পর মর্গের লোকজন সেখানে গোলাম হোসেন ভূঁইয়া নামের আরও একজনের লাশ রাখেন। তিনি সুবর্ণা আক্তারের খালু। গোলাম হোসেনের স্ত্রী পপি আক্তারের আহাজারিতে মর্গের সামনের সবার চোখেই পানি চলে আসে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কথা ভুলে গিয়ে সবাই তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। লঞ্চডুবির খবর পেয়ে স্বজনদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন পপি।

গোলাম হোসেনের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ শহরের কাঠপট্টি শাখারীবাজার এলাকায়। সেখানে স্থানীয় বাজারে তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। স্ত্রীর ভাগনি সুবর্ণা আর তার ছেলেকে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন।

গতকাল সকালে মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ছেড়ে আসা ছোট আকারের 'মর্নিংবার্ড' লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাটে ভেড়ার আগেই ময়ূর-২ নামের একটি লঞ্চ সেটিকে ধাক্কা দেয়। এতে সদরঘাটের ফরাশগঞ্জ ঘাটের অদূরে বুড়িগঙ্গার মাঝনদীতে লঞ্চটি ডুবে যায়।

মর্নিংবার্ড লঞ্চের যাত্রীদের স্বজনরা খবর পেয়ে ভিড় করেন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত। অপেক্ষা করতে থাকেন প্রিয়জনের পরিণতি জানার জন্য। দুপুরের দিকে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, বিআইডব্লিউটিএ এবং কোস্টগার্ডের উদ্ধারকর্মীরা ডুবে যাওয়া লঞ্চের ভেতর থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধার করতে থাকেন। ততক্ষণে স্বজনের কান্না-আহাজারি সদরঘাট থেকে মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। তাদের চোখের জলে একাকার হয় বুড়িগঙ্গার পানি।

শরীফ ইসলাম শিপলু হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী। মুন্সীগঞ্জে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ডুবে যাওয়া লঞ্চটিতে ছিলেন তিনিও। স্বজনরা দিনভর তার খোঁজ করতে থাকেন বুড়িগঙ্গা থেকে মর্গ পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত মর্গেই মেলে তার মরদেহ। শিপলুর মরদেহ শনাক্ত করতে গিয়ে বিলাপ করছিলেন তার বাবা সাহাদাত হোসেন। ছেলে হারানো এই বাবার কান্না ছুঁয়ে যায় লাশকাটা কাজে জড়িত মর্গের কর্মীদেরও।

শিপলুর মামা শ্বশুর মশিউর রহমান শুভ বলছিলেন, নিহতের ১১ মাস বয়সী একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। তিনি আফসোস করে বলছিলেন, শিশুটা বাবাকে চেনার আগেই ও এভাবে চলে গেল!

শামীম বেপারী পুরান ঢাকার ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা করেন। প্রতিদিন সকালে লঞ্চে মুন্সীগঞ্জের নিতাইবাজার এলাকা থেকে নিজের দোকানে আসেন। কাজ শেষে রাতে আবার লঞ্চেই চলে যান বাড়ি। গতকাল অবশ্য তিনি আগেভাগেই গেছেন বাড়িতে, তবে কফিন হয়ে।

লঞ্চডুবির খবর পেয়ে দুপুরের দিকে শামীমের স্ত্রী শিলা আক্তার সদরঘাটে আসেন। খোঁজ করতে থাকেন জীবনসঙ্গীর। শেষ পর্যন্ত মর্গে মেলে শামীমের নিথর দেহ। শিলা বিলাপ করে বলছিলেন, প্রতিদিন ঢাকায় দোকানে এসেই স্বামী তাকে ফোন দেন। কিন্তু গতকাল সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও ফোন পাচ্ছিলেন না। আর তাকে ফোন দিয়ে কেউ বলবে না দোকানে এসেছি।

সুমন তালুকদার যমুনা ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার কর্মী ছিলেন। প্রতিদিন মুন্সীগঞ্জের বাসা থেকে ঢাকায় এসে অফিস করতেন। গতকালও যথারীতি লঞ্চে চেপে বসেছিলেন। তিনি আর অফিসে যেতে পারেননি। লঞ্চডুবির পর তার নিথর দেহ উদ্ধার করে অফিসের অদূরেই অবস্থিত মিটফোর্ড মর্গে রাখা হয়।

এর আগে দুপুরে সুমন তালুকদারকে হণ্যে হয়ে খুঁজছিলেন তার ভাই সোহাগ তালুকদার। কখনও তিনি নৌকায় করে ছুটে যাচ্ছিলেন মাঝনদীতে। লাশবাহী ট্রলার তীরে ভিড়তেই হুমড়ি খেয়ে ভাইকে খুঁজতে থাকেন। বিকেলে ফোনে সোহাগ তালুকদার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তার ভাইয়ের লাশ খুঁজে পেয়েছেন। সুমনের তার দুটি শিশু সন্তান রয়েছে।

সদরঘাটের পন্টুনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছছিলেন আবদুর রউফ। তার কেউ নিখোঁজ কিনা জানতে চাইলে ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে ফেলেন। বললেন, লঞ্চডুবিতে মারা যাওয়া সবাই তার স্বজন, সবাই পরিচিত। আবেগাপ্লুত আবদুর রউফ জানান, তিনি ২০ বছর ধরে এই লাইনের লঞ্চে প্রতিদিন ঢাকায় আসেন। আবার বিকেলে চলে যান। তার মতো লঞ্চের প্রায় সব যাত্রীই সকালে ঢাকায় আসেন। কেউ ব্যবসা করেন, কেউ অফিসে চাকরি করেন। কাজ শেষে একসঙ্গেই তারা বাড়ি ফেরেন। ছোট্ট লঞ্চ হওয়ায় সবাই সবাইকে চিনতেন।

আবদুর রউফ বলেন, ঘটনার সময়ে তিনিও লঞ্চে ছিলেন। কীভাবে বেঁচে গেলেন, বুঝতে পারছেন না। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যবসায়ী সত্যরঞ্জন বণিকের সঙ্গে বসে ছিলেন তিনি। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, 'ও আর বের হতে পারেনি। প্রতিদিন গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরতাম। আর আজ ফিরছি ওর লাশ নিয়ে।'

আরও পড়ুন

×