টানা ৩৩ দিন অচল ঢাকা দক্ষিণ সিটি
অসহনীয় ভোগান্তিতে নগরবাসী
যাদের কারণে এই ভোগান্তি হচ্ছে তাদের এর মূল্য দিতে হবে ড. আদিল মুহাম্মদ খান

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন সোমবার নগর ভবনের কনফারেন্স রুমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মতবিনিময় সভা করেন। সভার ব্যানারে ইশরাকের পরিচয় হিসেবে ‘মাননীয় মেয়র’ লেখা দেখা যায় সমকাল
অমিতোষ পাল ও লতিফুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫ | ০১:১০
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ গ্রহণের দাবিতে টানা ৩৩ দিন কার্যত অচল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কার্যক্রম। এতে বন্ধ হয়ে গেছে সব ধরনের নাগরিক সেবা। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী।
এর মধ্যেই গতকাল সোমবার নগর ভবনে কর্মচারীদের নিয়ে একটি সভাও করেছেন ইশরাক। কর্মচারীরা তাঁকে ‘মাননীয় মেয়র’ হিসেবে সম্বোধনও করেছেন। তবে ১৪ মে থেকে আন্দোলন শুরু হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোরও কোনো তৎপরতা নেই। স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, কর্মচারীরা তাঁকে ‘মাননীয় মেয়র’ হিসেবে সম্বোধন করেছেন, তাহলে তো তাঁর শপথ তিনি নিজেই নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে কোনো কানাঘুষাও নেই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ সেবাসহ ২৮ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে সিটি করপোরেশন। গত এক মাসেরও বেশি সময় ডিএসসিসি নগর ভবন অবরুদ্ধ থাকার কারণে এসব সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী। সেবা না পাওয়ায় অসংখ্য নগরবাসীর ভোগান্তির অন্ত নেই।
গতকাল গোপীবাগের এক বাসিন্দা জানান, তাঁর সন্তানের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন। পাসপোর্ট করার জন্য তাদের সবার জন্মনিবন্ধন সনদ দরকার। কিছুই করতে পারছেন না।
পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা রাবেয়া বেগম এক মাস ধরে নগর ভবনে যাচ্ছেন ওয়ারিশ সনদ নিতে। তিনি বলেন, দুই দিনে পারিবারিক সনদ হয়ে যায়; এক মাস ধরে ঘুরেও পাচ্ছি না।
ঈদের ছুটিতে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরা রাইসুল ইসলাম বলেন, বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে আবার সৌদি যাব। সেভাবেই অনেক কষ্ট করে ছুটি ম্যানেজ করে এসেছিলাম। ২১ জুন ফিরতি ফ্লাইট। কিন্তু আন্দোলনের কারণে এখন পর্যন্ত নগর ভবনেই ঢুকতে পারিনি।
ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া তীব্র হতাশা ব্যক্ত করে সমকালকে বলেন, দাপ্তরিক কাজগুলোর কোনোটাই করা যাচ্ছে না। ময়লা পরিষ্কার, মশার ওষুধ বিতরণ, সড়কবাতি লাগানোর মতো কাজও স্বাভাবিকভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া অসংখ্য প্রয়োজনে প্রতিদিন হাজারো মানুষ নগর ভবনে আসেন। কিন্তু তাদের কষ্টের কথার কোনো জবাব দিতে পারছি না। দু-চারটি জরুরি সেবা ছাড়া কোনো সেবাই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন নগর ভবনে বিভিন্ন প্রয়োজনে যান পাঁচ থেকে সাত হাজার নগরবাসী। তাদের এই প্রয়োজনগুলো মিটছে না। একাধিক প্রকৌশলী জানান, নগর ভবন অবরুদ্ধ থাকায় চলমান রাস্তাঘাটের উন্নয়নকাজ তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। ভারী বর্ষার কারণে অনেক এলাকার রাস্তাঘাট ভেঙে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সেগুলো মেরামত না করায় ঘটছে দুর্ঘটনা।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, রাজধানীর মতো একটি শহরের সেবা কার্যক্রম দিনের পর দিন অচল থাকতে পারে না। মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে যদি তারা রাজনীতি করেন, সেই রাজনীতি কেউ গ্রহণ করবে না। যাদের কারণে নগরবাসীর এই ভোগান্তি ঘটছে, এ জন্য তাদের মূল্য দিতেই হবে।
নগর ভবনে আজ ও কাল বৈঠকের ঘোষণা
ডিএসসিসি মেয়র হিসেবে শপথ নিতে না পারলেও গতকাল নগর ভবনে সভা করেছেন ইশরাক হোসেন। সোমবার সকালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকদের নিয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে কর্মকর্তাদের বৈঠকের ব্যানারে নামের সঙ্গে মেয়র লিখতে পারেন কিনা– এ প্রশ্নে ইশরাক সাংবাদিকদের বলেন, আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি, আইন-আদালতের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছি। নির্বাচন কমিশনের গেজেটেও স্পষ্টভাবে আমাকে মেয়র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যে কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানালে ব্যানারে আয়োজকরা মেয়র লিখতে পারেন। এটি নিয়ে যারা কথা বলছেন, তারা যেন নিজেদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করে কথা বলেন।
দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে মশক নিধন, জন্মসনদসহ বিভিন্ন নাগরিক সেবা নিজেদের তত্ত্বাবধানে চালু রাখার বিষয়ে কথা বলেন এই বিএনপি নেতা। এ সময় তিনি আদালতের রায় মেনে মেয়র পদে শপথ গ্রহণের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানান।
ইশরাক আরও বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সরকার আমাকে মেয়র পদে বসানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তারা রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বিএনপির প্রার্থীকে বসতে দেবে না। তাদের পছন্দের প্রশাসক বসিয়ে জাতীয় নির্বাচনে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করবে। এতদিন ধরে আন্দোলন চললেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের যোগাযোগ ও আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। আমরা ঢাকা শহরে মশক নিধন কর্মসূচিকে বেগবান করার জন্য ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করছি। সোমবার ৭০টি ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকদের সঙ্গে আমরা বৈঠকে বসেছিলাম। মঙ্গলবার আমাদের ৭০টির বেশি ওয়ার্ড সচিবের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। বুধবার স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তার সঙ্গে আমরা বৈঠক করব।
- বিষয় :
- বিএনপি
- ইশরাক হোসেন