ঢাকা শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাজপথ তছনছ

রাজপথ তছনছ

রাস্তার এই বেহালদশা রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকার- মাহবুব হোসেন নবীন

অমিতোষ পাল

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২০ | ১৫:২৩

রাজধানীর ব্যস্ততম মতিঝিলের বিমান অফিসের সামনে দিলকুশার সড়কটি প্রায় ছয় মাস ধরে ভাঙাচোরা। মাটির নিচে পাইপ বসাতে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছিল। পরে আর মেরামত করা হয়নি। সম্প্রতি অতি বর্ষণে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এখন এ পথ চলাচল করাই দায়।

এ চিত্র কেবল মতিঝিল এলাকারই নয়। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় এখন রাস্তা ভাঙাচোরা। বর্ষা মৌসুমে পানি জমে অনেক ভালো রাস্তাও ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। জমে থাকা পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর বহু স্থানে কঙ্কালসার রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এসব পথে যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। কমবেশি দুর্ঘটনাও ঘটছে।

রাস্তা মেরামত ও আধুনিকায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা বলছেন, রাজধানীর রাস্তা তৈরিতে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। বিটুমিনের প্রধান শত্রু পানি। ভালো রাস্তায় পানি জমলেই রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। তারা প্রত্যেকটি আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে ভাঙা রাস্তার তথ্য সংগ্রহ করছেন। যেগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ, সেগুলো মেরামত করে দেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই সেগুলো আধুনিকায়নের কাজও শুরু হবে। এ ছাড়া কিছু রাস্তা আধুনিকায়নের কাজও বর্তমানে চলমান।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এবার বর্ষা মৌসুমে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। এসব রাস্তা মেরামত করা হচ্ছে। পাশাপাশি রাস্তা আধুনিকায়নের জন্য একটি প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। সেগুলোর কাজ চলছে। এ ছাড়া ডিএনসিসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ১৮টি নতুন ওয়ার্ডের রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে আধুনিকায়ন করার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই সেই প্রকল্পের কাজও শুরু হবে। তবে ডিএনসিসি এলাকার বেশিরভাগ রাস্তাই এখন ভালো বলে তিনি দাবি করেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ডিএসসিসি এলাকার রাস্তা তদারকির সমন্বয়কারী ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হাশেম বলেন, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের পশ্চিম পয়েন্টে নামার সময় আনন্দবাজার এলাকার রাস্তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ সেখানে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল। এখন সেখানে মেরামতের কাজ চলছে। এ ছাড়া অন্য যেসব রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো মেরামত করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে এই প্রকল্পটি চলমান। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ আধুনিকায়ন করা যাচ্ছে না। বর্ষা মৌসুম শেষে এগুলো আধুনিকায়নের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। মুন্সি আবুল হাশেম আরও বলেন, অন্যান্য বছরও বৃষ্টিতে যে রকম ক্ষতি হয়, এবারও সে রকমই হয়েছে। কিন্তু রাজধানীর একটি বড় এলাকায় মেট্রোরেলের কাজ চলছে। এ জন্য ওই সব রাস্তার অবস্থা বেশি খারাপ। এ কারণে মনে হয় রাস্তা বেশি ভাঙাচোরা।

দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দুই সিটিতে প্রধান সড়কসহ অলিগলি মিলিয়ে মোট রাস্তার পরিমাণ ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ডিএনসিসি এলাকায় ১ হাজার ৪৫০ কিলোমিটার ও ডিএনসিসি এলাকায় ১৬৫০ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। সংশ্নিষ্টরা জানান, দুই সিটির ৩০ শতাংশ রাস্তাই বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ডিএসসিসি এলাকার রাস্তা। ডিএসসিসি এলাকার ৬০০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ডিএনসিসি এলাকার ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, রাস্তায় পানি জমা অবস্থায় যানবাহন চলাচল করলে রাস্তা ভেঙেচুরে যায়। এমন ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যাতে অতিবর্ষণেও রাস্তায় পানি না জমে। এজন্য প্রথমেই রাজধানীর খালগুলোর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা আধুনিক করতে হবে, যাতে বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমতে না পারে। এ ছাড়া রাস্তা নির্মাণের সময় গুণগত মান ঠিক রাখা। যেটা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে করা হয় না। এ দুটি বিষয় ঠিক রাখতে পারলে প্রতি বর্ষা মৌসুমে এভাবে রাস্তার ক্ষতি হবে না। অর্থেরও অপচয় হবে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, মতিঝিলের বিমান অফিস থেকে নয়াপল্টন সড়ক পর্যন্ত রাস্তাটি ভেঙেচুরে একেবারে তছনছ। সবচেয়ে বাজে অবস্থা দৈনিক বাংলার মোড় পয়েন্টে। এরই মধ্যে মোড়ের মধ্যে রাস্তার একাংশে বেশ কয়েকটি মোটা পাইপ ফেলে রাখা হয়েছে। ফলে রাস্তা সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় গাড়িগুলো দ্রুত পারও হতে পারছে না। আগারগাঁও চৌরাস্তা পয়েন্টে রাস্তার অবস্থা বেহাল। আইডিবি ভবনের সামনের রাস্তাটি এতই ভাঙাচোরা যে, গাড়িগুলোকে ধীরে ধীরে চলতে হয়। ওই পয়েন্টে যানজট লেগেই থাকে। একই অবস্থা রোকেয়া সরণির আবহাওয়া অফিসের সামনে। অলিগলিগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে কচুক্ষেতগামী রাস্তাও ভেঙেচুরে একাকার। ১০ নম্বর পয়েন্টের অবস্থাও সঙ্গীন। তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডের অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ। কয়েকটি স্থানে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাকের চাকা পড়লে উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। অন্যান্য স্থানের বাকল উঠে গেছে।

পথচারীরা জানান, রাজধানীর রাস্তাগুলো সারা বছরই কমবেশি ভাঙাচোরা, খানাখন্দ থাকে। আর বৃষ্টি হলেই দগদগে ক্ষত বেরিয়ে পড়ে। প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে শাখা সড়ক, সরু অলিগলিরও অভিন্ন চেহারা। এসব রাস্তায় হেঁটে চলাও কষ্টকর। বাস, মিনিবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি, রিকশা সবই চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। প্রায়ই পানিভর্তি খানাখন্দে চলন্ত যানবাহনের চাকা আটকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। আরোহীসহ উল্টে যাচ্ছে রিকশা-ভ্যান। গাবতলী, তেজগাঁও, ফার্মগেট, কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা, পুরান ঢাকা ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা মতিঝিল থেকে পল্লবী পর্যন্ত সড়কটির। এ সড়কের ওপর তৈরি হচ্ছে মেট্রোরেল। মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের কারণে এসব সড়ক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন নগরবাসী। অনেক সময় উপায় না পেয়ে চলাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

পথচারীরা বলছেন, রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা তো আছেই। পাশাপাশি প্রায় সারা বছরই চলে গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন লাইন বসানোর জন্য খোঁড়াখুঁড়ি। এসব খোঁড়াখুঁড়ির পর সড়ক মেরামতেও দীর্ঘ সময় নেয় কর্তৃপক্ষ। সড়কগুলোর বেহাল অবস্থার কারণে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে রাজধানীতে। করোনার পর রাজধানীর জনসংখ্যা ও যানবাহনের সংখ্যা কমে গেলে ভাঙা রাস্তার কারণে বর্তমানে অনেক স্থানেই যানজট হচ্ছে। অনেক স্থানে সড়কের ওপর রেখে দেওয়া হচ্ছে মোটা মোটা পাইপ, ইট-বালুসহ নির্মাণসামগ্রী। এসব কারণে বিদ্যমান রাস্তাও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ওই সব সড়কে যানবাহন দ্রুত চলতে পারছে না। আর বৃষ্টি হলে তো ভোগান্তির শেষ নেই। কাদা, পানি, বর্জ্য মিলেমিশে নাস্তানাবুদ অবস্থা। এসব সড়কে জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে। অনেক স্থানে রাস্তার পাশাপাশি ফুটপাতও ভেঙে গেছে। নগরবাসী যে ফুটপাত দিয়ে স্বস্তিতে হাঁটবে, তারও উপায় নেই। রাজধানীর পূর্বাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ডেমরা, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, মুগদা ও সবুজবাগ এলাকায় এবার বন্যার কারণে বেশি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অনেক স্থানে বাসাবাড়িতে পানিও ঢুকে পড়ে। ওই সব এলাকার রাস্তাঘাটগুলোর অবস্থা আরও খারাপ।

সিটি করপোরেশনের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো সড়কের খনন করার প্রয়োজন দেখা দিলে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে তা শেষ করতে হবে। আর বর্ষা মৌসুমের আগেই সব খোঁড়াখুঁড়ি শেষ করে মেরামত কাজ শেষ করতে হবে। বাস্তবে বেশিরভাগ সময়ই তা অনুসরণ করা হয় না। কাফরুলের বাসিন্দা বাদল সূত্রধর জানান, এলাকায় সকালবেলা হাঁটার মতো উন্মুক্ত কোনো পার্ক নেই। রাস্তা-ফুটপাত ধরে হাঁটতেন। কিন্তু ফুটপাতেরও এখন বেহাল দশা। কাজেই সকালবেলা হাঁটাও বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার তাকে নিয়মিত হাঁটতে বলেছেন।

রাস্তা আধুনিকায়ন ও মেরামতের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালনকারী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএম শরীফ উদ্দিন দাবি করেন, বর্তমানে ডিএনসিসি এলাকার রাস্তার মান ভালো। অতি বর্ষণে কিছু রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। আর কিছু রাস্তা মেট্রোরেলের কারণে আধুনিকায়ন করা যাচ্ছে না। তবে বৃষ্টিতে যেসব রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে।

আরও পড়ুন

×