ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিবাদ

'আর কেটো না গাছ, নিতে দাও নিঃশ্বাস'

'আর কেটো না গাছ, নিতে দাও নিঃশ্বাস'

ছবি :সমকাল

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২১ | ০৯:১২ | আপডেট: ০৭ মে ২০২১ | ১২:৩৪

কংক্রিটের শহর ঢাকা। এর মধ্যে সবুজে ঘেরা ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অক্সিজেন নেওয়ার নির্মল জায়গা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য এ অংশে বহু প্রাচীন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ কেটে রেস্তোরাঁ ও হাঁটার পথ নির্মাণের প্রতিবাদে দানা বাঁধছে আন্দোলন। অভিনব উপায়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন পরিবেশবাদীরা। তাদের কেউ বানিয়েছেন বড় পাখির বাসা, কেউ প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করেছেন মগডালে উঠে। অন্যরা আবার গাছের চারা রোপণ করেছেন প্রতিবাদ হিসেবে।

কাটা গাছের গুঁড়ির পাশেই গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় নতজানু হয়ে বসে মোমবাতি জ্বালালেন কিছু মানুষ। গাছ 'হত্যা'র প্রতিবাদে শামিল হন তারা। করোনার বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই শাহবাগ, টিএসসি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় গতকাল দিনভর গাছের জন্য আন্দোলন ও মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন সবুজপ্রেমীরা।

বক্তৃতা, কবিতা, গান, নাটক, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, মৌন মিছিল, পদযাত্রা, মোমবাতি প্রজ্বালন, গাছ রোপণসহ নানা কর্মসূচিত মুখর ছিল শাহবাগ এলাকা। গাছের জন্য আন্দোলনে শামিল হয়েছেন শিক্ষক, সংস্কৃতি কর্মী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। ছিল ব্যানার-পোস্টার। তাতে লেখা ছিল, 'গাছ বাঁচাও, ভবিষ্যৎ বাঁচাও', 'আর কেটো না গাছ, নিতে দাও নিঃশ্বাস', 'বাণিজ্যিক স্বার্থে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস বন্ধ কর'।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসির সামনের গেটে গতকাল বিকেলে 'গাছের জন্য মৌন পীড়ন' শিরোনামে তরুণী শিল্পীদের একটি দল কর্মসূচি পালন করে। এই কর্মসূচির আয়োজকদের একজন সুজিত সজীব সমকালকে বলেন, গাছ কাটার প্রতিবাদে তারা ফেসবুকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। গতকাল শুক্রবার তারা রাস্তায় নেমেছেন। তরুণ শিল্পীরা মূলত এই আন্দোলনে এক জোট হয়েছেন। গাছের স্মরণে শোকসভা, গান, কবিতা, পথনাটক ও পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছেন। গান, কবিতা আর নাটকের মধ্য দিয়ে গাছের কষ্ট ও বেদনা তারা তুলে ধরছেন। পাশাপাশি মানুষকে তারা সচেতন করছেন। গতকাল সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মাণাধীন ক্যান্টিনের সামনে গাছের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন করেছেন তারা।

বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথের ছবির হাটে কবি-লেখক-শিল্পী, ছোট কাগজ ও সংস্কৃতি কর্মীদের উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধন শেষে তারা বেশ কয়েকটি গাছ রোপণ করেন। মানববন্ধনে বক্তব্য দেন চলচ্চিত্র নির্মাতা জুনায়েদ হালিম, নোঙর বাংলাদেশের সভাপতি সুমন শামস, চারণিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুল হক আরিফ, সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের যুগ্ম আহ্বায়ক জাকির হোসেন, সাংস্কৃতিক সংগঠন চারণের সংগঠক সুস্মিতা রায়, কবি হাসান ফকরী প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন লোক সম্পাদক অনিকেত শামীম। সংহিতা প্রকাশ করে আরও অনেকে মানববন্ধনে বার্তা পাঠান।

এ সময় বক্তারা বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রক্ষা করতে পরিবেশবান্ধব প্রকৌশলী নিয়োগ করা প্রয়োজন। যিনি গাছ না কেটে, গাছ রেখেই সুন্দর উদ্যান তৈরি করতে পারবেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ যাবৎকালে যত গাছ কাটা হয়েছে, তার বিপরীতে ১০ হাজার গাছ লাগাতে হবে।

জুনায়েদ হালিম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত প্রধান স্থানগুলোর একটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এখানে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা এর নাম রেখেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। তিনি এখানে বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন। তার পরিকল্পনায় রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় উদ্যানে। সেখানে আমরা হোটেল, রেস্তোরাঁর নামে ভোগবিলাসের জায়গা বানাতে দেব না। গাছ কাটা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। বক্তারা বলেন, ঢাকাবাসীর শ্বাস গ্রহণের ফুসফুসসম এই নান্দনিক স্থানটির ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরোনো গাছগুলো কাটা হচ্ছে খাবারের দোকান বানানোর জন্য।

সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে পরিবেশবাদী যুব সংগঠন 'গ্রিন ভয়েস' গাছ কাটার প্রতিবাদে ছাত্র-যুব সমাবেশের আয়োজন করে। সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক আলমগীর কবিরের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক হুমায়ুন কবির সুমনের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান শরীফ, গ্রিন সেভার্সের প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি, লালন গবেষক সরদার হীরক রাজা, গ্রিন ভয়েসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নাসরিন জান্নাত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ইশরাত জাহান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমন্বয়ক সাচিনু মারমা প্রমূখ।

এ সময় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংহতি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান এম এম আকাশ ও সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সবার দম নেওয়ার একটি বৃহৎ স্থান। এখানকার গাছ কাটা ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। বৃক্ষ নিধনের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে আরও বৃক্ষময় করে গড়ে তুলতে হবে। এ সময় বক্তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দাবি জানান।

এদিন 'গাছ কাটার বিরুদ্ধে গাছ রোপণই হোক প্রতিবাদের ভাষা' কর্মসূচিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিটি কাটা গাছের জায়গায় নতুন চারাগাছ রোপণ করছে ছাত্র ফেডারেশন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটার প্রতিবাদে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।

ভিন্নধর্মী নানা আন্দোলন এবং গাছের জন্য ভালোবাসা দেখা গেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিভিন্ন স্থানে। গাছ কাটার প্রতিবাদে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছের ডালপালা দিয়ে একটি বড় পাখির বাসা বানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আশিকুল ইসলাম। ১০ দিনের বেশি সময় ধরে তিনি বন্ধুদের নিয়ে প্রতিবাদ করছেন বলে সমকালকে জানান।

এখন এ প্রতিবাদের মঞ্চ উন্মুক্ত। এতে অনেকেই সংহতি প্রকাশ করছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনটি গগনশিরীষগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এই গাছগুলোতে চিল বসত। এখন পাখিগুলো যাবে কোথায়? উদ্যানের ভেতরেই বেশকিছু পরিবেশপ্রেমী তরুণকে কাটা গাছের স্থানে গিয়ে ছবি তুলতে দেখা যায়। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা, 'উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস বন্ধ করুন।'

গাছ কাটার প্রতিবাদে প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় কবি অনিন্দ্য অমাত বেছে নিয়েছেন অভিনব প্রতিবাদ। উদ্যানের ভেতরে একটি গাছের মগডালে উঠে প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করেছেন তিনি। বিকেলে ঘণ্টাব্যাপী প্রতিবাদী কবিতা পাঠ করেন তিনি। আয়োজনটি ফেসবুক লাইভে প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর কমেন্টসের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ এই প্রতিবাদের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করেন। কবিতার ফাঁকে ফাঁকে এই আন্দোলনে সবাইকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান অনিন্দ্য।

আরও পড়ুন

×