'বুকের ওপর বসে স্বামীর গলা কাটেন স্ত্রী'

স্বামী ময়নাকে খুনের ঘটনা স্বীকার করেছেন স্ত্রী ফাতেমা -সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১ | ০৯:৫৭ | আপডেট: ০১ জুন ২০২১ | ১০:০৪
স্বামী ময়না মিয়ার দ্বিতীয় বিয়ে এবং পারিবারিক নানা কারণে প্রথম স্ত্রী ফাতেমা খাতুনের ক্ষোভ ছিল তার ওপর। এ কারণে স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জুসের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে অচেতন করার পর ময়না মিয়াকে খুন করা হয়।
গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে স্বামীকে খুনের বর্ণনা দিয়ে ফাতেমা বলেন, 'বুকের ওপর বসে চাকু দিয়ে ওর গলা কাটতে শুরু করি। শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলি। এরপর দুই পা ও দুই হাতও শরীর থেকে আলাদা করি। লাশ গুম করার উদ্দেশে ড্রামে ও দুটি ব্যাগে লাশের টুকরো নিয়ে রিকশায় করে রাজধানীর তিনস্থানে ফেলে আসি।'
মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উত্তরের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফাতেমা একাই ময়না মিয়াকে খুন করে লাশ কয়েক টুকরা করেন।
নিহতের দ্বিতীয় স্ত্রী নাসরিন বাদী হয়ে ফাতেমাকে আসামি করে সোমবার বনানী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তাকে ১০ দিনের রিমাণ্ড আবেদন করে মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে পুলিশ। আদালত তার পাঁচ দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন।
নিহতের স্বজনরা জানান, ময়না মিয়ার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। তিনি সেখানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করতেন। তার প্রথম স্ত্রী ফাতেমা থাকেন মহাখালীর কড়াইল এলাকায়। বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রান্নার কাজ করেন তিনি। ময়না মিয়া মাঝেমধ্যে ফাতেমার কাছে আসতেন।
নিহতের মেজো ভাই সুরুজ মিয়া বলেন, তার ভাইকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা নিশ্চিত না হলেও ধারণা করছেন, পারিবারিক কলহের কারণে খুন করা হয়েছেন তিনি।
পুলিশ জানিয়েছে, রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মহাখালীর আমতলীতে রাস্তার পাশে ড্রামের মধ্যে হাত-পা-মাথাবিহীন শরীরের অংশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর রাত সাড়ে ১২টায় মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ব্যাগবন্দি দুই হাত-পা উদ্ধার করা হয়। ফাতেমাকে গ্রেপ্তারের পর তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সোমবার বিকেলে বনানী লেকে পাওয়া যায় খণ্ডিত মাথা।
ময়না মিয়া খুন ও ফাতেমা গ্রেপ্তারের বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুর ১টায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিন্টো রোডের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ জানান, ময়না মিয়ার একাধিক বিয়ে, টাকা-পয়সা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও পারিবারিক কলহের কারণে প্রথম স্ত্রী ফাতেমার সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়। এ কারণেই ফাতেমা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন। লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে টুকরো করে তিন স্থানে ফেলা হয়েছিল। গত রোবববার ফাতেমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি একাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। নিহতের রক্তমাখা জামাকাপড় এবং হত্যায় ব্যবহৃত চাকু, দা ও পাটা উদ্ধার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২৩ মে ময়না মিয়াকে কিশোরগঞ্জ থেকে রাজধানীর কড়াইলের বাসায় ডেকে আনেন ফাতেমা। খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত ময়না সেখানেই ছিলেন। ২৮ মে রাতে ফাতেমা তাকে জুসের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ান। আগে থেকেই তিনি দুই পাতা ঘুমের ট্যাবলেট কিনে ঘরে রেখেছিলেন। পরদিন সন্ধ্যার পর কিছুটা সম্বিত ফিরে পান ময়না, অবশ্য তখনো ঘুমের ঘোর কাটেনি তার। এ অবস্থায় স্ত্রীকে গালমন্দ করেন। আবারও ট্যাবলেট মেশানো জুস খাওয়ানো হয়। এতে খাটে নিস্তেজ হয়ে পড়লে ওড়না দিয়ে তার দুই হাত শরীরের সঙ্গে বেঁধে মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। এরপর বুকে বসে স্বামীর গলায় ছুরি চালাতে শুরু করেন তিনি। এক পর্যায়ে ময়না চেতনা ফিরে পেয়ে উঠে পড়েন। দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। স্ত্রীকে খামছে দেন তিনি। এরপর তিনি খাট থেকে মেঝেতে পড়ে যান। ফের বুকে বসে গলা চাকু দিয়ে কেটে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। রাতভর লাশ নিয়ে ঘরে বসে থাকেন ফাতেমা। ৩০ মে সকালে চাকু দিয়ে লাশের হাতের চামড়া ও মাংস কাটেন। এরপর দা দিয়ে উরু থেকে দুই পা ও কাঁধের নিচ থেকে দুই হাত কেটে বিচ্ছিন্ন করেন ফাতেমা। হাত ও পায়ের হাড় কাটতে শিলপাটা ব্যবহার করা হয়। টুকরোগুলো তিনভাগ করা হয়। একটি ব্যাগে মাথা, অপর একটি ব্যাগে হাত-পা ও নীল রংয়ের ড্রামে শরীরে বাকি অংশ ঢোকানো হয়। সারাদিন লাশের টুকরাগুলো ঘরে রাখেন তিনি। রাতে বৃষ্টির সময় ১৩০০ টাকায় একটি রিকশা ভাড়া করে হাত-পা ভর্তি ব্যাগ ও ড্রামে রাখা মাথা-হাত-পাবিহীন অংশটি নিয়ে বের হন। রাত ৮টার দিকে ড্রামটি ফেলেন মহাখালীর আমতলীতে এবং হাত-পায়ের ব্যাগটি মহাখালীর বাস টার্মিনালের ফেলে বাসায় চলে আসেন। মাথার ব্যাগটি নিয়ে একই রিকশায় গিয়ে বনানী ১১ নম্বর ব্রিজের পূর্বপাশের লেকের পানিতে ফেলে বাসায় ফেরেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ফাতেমা ভেবেছিলেন লাশের টুকরো যেহেতু তিন স্থানে ফেলা হয়েছে, সুতরাং লাশ কখনও শনাক্ত হবে না। আর লাশের পরিচয় অজ্ঞাত থাকলে তিনিও থাকবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। হাত-পা উদ্ধারের পর ফিঙ্গার প্রিন্ট পরীক্ষা করে নিহতের পরিচয় পায় পুলিশ। এর পরই ফাতেমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন স্বজনরা।