
ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা এলেও বাজারে এখনও বাড়েনি সরবরাহ। ঈদের আগে থেকে তেলের যে সংকট ছিল তা এখনও রয়ে গেছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারসহ দেশের অনেক স্থানেই বোতলজাত ও খোলা তেলের দেখা মেলেনি।
ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো কিছুদিন ধরে কারসাজির মাধ্যমে যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে সেটাকে ঢাকতে দাম বাড়ানোর পরও স্বাভাবিক সরবরাহের দিকে এখনই হাঁটছে না। এর আগেও তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে, কোনোবারই সরবরাহ নিয়ে সংকট তৈরি হয়নি। এবারই সরবরাহে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
তবে কোম্পানিগুলো দাবি করছে, সরবরাহ স্বাভাবিক। যতটা ঘাটতি আছে তা কর্মীরা ঈদের ছুটিতে থাকার কারণে। আগামীকাল রোববার থেকে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে ভোজ্যতেল সরবরাহ।
গতকাল সকালে রাজধানীর মালিবাগ বাজার ও বিকেলে কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ দোকানে বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল নেই। মিলছে না পাম অয়েলও।
তেল না থাকার কারণ জানতে চাইলে সয়াবিন ও পাম অয়েল পরিশোধনকারী একটি কোম্পানির ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এক মাস ধরে তার কোম্পানি সরবরাহ ধীরে ধীরে কমিয়েছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে সরবরাহ পুরো বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাকে নয়, ওই কোম্পানি সারাদেশের ডিলারদের সরবরাহই কমিয়ে দেয়। তিনি বলেন, 'আমরা শুনেছি পরিশোধনকারী কোম্পানি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কিনে তা দেশে না এনে তেলভর্তি জাহাজ সিঙ্গাপুর বন্দরে নোঙর করে রেখেছে। আরও কয়েকটি কোম্পানিই নাকি এমন করেছে।'
একই অভিযোগ অন্য সাধারণ ব্যবসায়ীদেরও। মালিবাগ বাজারের হাসিব এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা শাফায়াত হোসেন বলেন, 'কোম্পানি তেল না দিলে আমরা কীভাবে বিক্রি করব। ঈদের আগে থেকে সব কোম্পানির সরবরাহ বন্ধ। অনেক অনুরোধ করে ঈদের আগে অল্প কিছু তেল পাওয়া গেছে। কোম্পানির প্রতিনিধিদের বারবার ফোন করেও এখন তেল মিলছে না। আজ (শুক্রবার) ফোন করলে কোম্পানির প্রতিনিধিরা আগামীকাল (শনিবার) আসতে বলেন।'
খুচরা বিক্রেতা ও ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মার্চে সরকার ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে থাকা ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করে এবং উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ের ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়। আমদানি খরচ কমানোর এই সুবিধা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রতি লিটারে ৮ টাকা দাম কমিয়ে নতুন দর নির্ধারণ করে। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি করলে লোকসান হবে এই যুক্তিতে তেল বিক্রি করতে চাননি। ফলে পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো গত মার্চে দাম সমন্বয়ের পর থেকেই বিভিন্ন কৌশলে সরবরাহের রাশ টেনেছে। প্রথমে খোলা তেলের সরবরাহ কমিয়েছে। পরে বোতলজাত তেলের সরবরাহও কমিয়ে দেয় কোম্পানিগুলো। ফলে ঈদের আগে বাজার থেকে সয়াবিন ও পাম অয়েল অনেকটা উধাও হয়ে যায়।
এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে ভিন্ন কথা। এ সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে, মার্চের তুলনায় এপ্রিলে পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো সরবরাহ বাড়িয়েছে। যদিও জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তুলনায় পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো মার্চে সরবরাহ কমিয়ে দেয়।
অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মনজুর মোহাম্মাদ শাহরিয়ার সমকালকে বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এপ্রিলের ২৬, ২৭ ও ২৮ তারিখে বিভিন্ন ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানি পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শনে দেখা গেছে, কোম্পানিগুলো মার্চের তুলনায় এপ্রিলে সরবরাহ বাড়িয়েছে।
তার পরও বাজারে ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোক্তা অধিদপ্তর বাজারগুলোতে অভিযান চালিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ঈদের পরে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে পারে এমন খবরে ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা তেল বিক্রি না করে মজুত করছেন। কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর বাজারে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে মজুত তেল পাওয়া গেছে। এভাবে সারাদেশে মজুত করা হয়েছে তেল। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা গুদামে বা দোকানে তেল না রেখে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন। যথাযথ তথ্য ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে কিছু করাও সম্ভব হচ্ছে না।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, সরবরাহ কোনো সময় কমানো হয়নি।
বর্তমানে কর্মীদের অনেকেই ঈদের ছুটিতে আছেন। যে কারণে তাৎক্ষণিক সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া নতুন দরের লেভেল তৈরিতেও কিছুটা সময় লাগে। আশা করা যাচ্ছে, আগামীকাল রোববার থেকে বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।
একই আশা ব্যক্ত করেছেন টিকে গ্রুপের পরিচালক সফিউল আথহার তাছলিম। তিনি বলেন, ঈদের আগে ও পরে সাধারণত কারখানাসহ অন্যান্য বিভাগ বন্ধ থাকে। আশা করা হচ্ছে, আজ শনিবার বিকেল থেকে ডিলারদের গাড়ি লোড করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার নতুন করে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৪৪ টাকা আর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আর পাম অয়েলের দাম লিটারে ৪২ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে যা রেকর্ড। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও ব্যবসায়ীদের নতুন দরে সায় দিয়েছে। এখন থেকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল কিনতে হবে ১৮০ টাকায়। আর সয়াবিন তেলের এক লিটারের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৮ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা। আর প্রতি লিটার পাম অয়েলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭২ টাকা।
আসছে পাউসপ্যাক জটিলতা :এদিকে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের সরবরাহ নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে। শিল্প মন্ত্রণালয় আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে ৩১ মের পরে খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি করা যাবে না। বোতলজাতকরণের বাইরে তেল বিক্রি করতে হলে তা প্লাস্টিকের প্যাকেটে করতে হবে। যেখানে কী তেল, পরিমাণ, প্যাকেটজাতের তারিখ, কতদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে এবং মূল্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। খোলা অবস্থায় সয়াবিন তেলের নামে পাম অয়েল বিক্রি বন্ধ এবং ওজনের কারসাজি রুখতে এ উদ্যোগ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া তেলে ভিটামিন মেশানোও (ফর্টিফিকেশন) এর উদ্দেশ্য। কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে এখনও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়নি। তারা ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চায়। পাশাপাশি ঢাকার মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরাও এই ব্যবস্থা দেরিতে চালু করার পক্ষে। তারা বলছেন, শিল্প কারখানায় ড্রামে তেল সরবরাহ করার বিকল্প নেই। বিশেষ করে চানাচুর, চিপস, বেকারি, ছোট প্রসাধনী কারখানায় ড্রামে সরবরাহ করতে হবে। এ ছাড়া দেশের দরিদ্র শ্রেণির জন্য খোলা তেল বিক্রির ব্যবস্থা রাখাও জরুরি।
এ ব্যাপারে বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, তার কোম্পানি সিটি গ্রুপ পাউসপ্যাকে তেল সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এজন্য তারা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেবে।
টিকে গ্রুপের পরিচালক সফিউল আথহার তাছলিম বলেন, পাউসপ্যাকে সরবরাহে জোর দেওয়ার চেয়ে কোনটা সয়াবিন আর কোনটা পাম অয়েল তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের বেশি নজর দেওয়া দরকার। তিনিও ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন।
মৌলভীবাজারের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, সম্প্রতি বড় বাজারগুলোতে ভোজ্যতেল সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে সামগ্রিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি খোলা তেলের সরবরাহ বন্ধ করা হলে তা আরও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
মন্তব্য করুন