ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও আমাদের করণীয়

করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও আমাদের করণীয়

মো. শাহীন মোল্লা

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২০ | ০৯:১৯ | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ | ১৩:২০

করোনাভাইরাস সবচেয়ে দ্রুত সংক্রমণশীল ভাইরাস এবং এর সংক্রমণ প্রতিনিয়ত দেশে-বিদেশে বেড়েই চলেছে।  প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মধ্য-প্রাচ্যসহ কোন দেশই রক্ষা পাচ্ছেনা। কোভিড-১৯ রোগে ইতিমধ্যে ১৮৫টি দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছে ৫ লাখের বেশি এবং মৃতের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১৮৩৮ জন। এদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৭৫ জন, সুস্থ হয়েছে ৫৮ জন এবং চিকিৎসাধীন আছে ১৭০৫ জন (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ১৭ এপ্রিল, ২০২০)। যদিও করোনাভাইরাসের  লক্ষণ- জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ৩০ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ১৯ দিনে সারাদেশে ১৭১ জন মারা গেছেন (সমকাল অনলাইন, ১৭ এপ্রিল, ২০২০)।

এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক ব্যক্তিকে হোম বা প্রাতিষ্ঠানিক  কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়েছে এবং বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন পাঁচ শতাধিক। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি  চলছে এবং পর্যায়ক্রমে তার মেয়াদ বেড়ে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে এই ছুটির মেয়াদ আরো বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের ৫১টি জেলায় করোনার সংক্রমণের তথ্য জানিয়েছে আইইডিসিআর। ফলে সমগ্র বাংলাদেশকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার ৫০টির অধিক এলাকা, দেশের ২৯টি জেলা পুরোপুরি এবং ১৯টি জেলা আংশিক লকডাউন করা হয়েছে (সমকাল অনলাইন, ১৭ এপ্রিল, ২০২০) এবং প্রতিদিনই লকডাউনের পরিধি বাড়ছে।

যেহেতু বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ পর্যায়ে প্রবেশ করছে তাই এখন দ্রুত কমিউনিটিতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। এই সময় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সবচেয়ে প্রধান কাজটি হচ্ছে বেশি বেশি বাড়ির ভিতরে থাকা। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষই বাড়ির মধ্যে আছে; কেউ কেউ লকডাউন  অবস্থায় আছে; কেউ বাড়ির বাইরে বের হলে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং বা সামাজিক দূরত্ব মানতে হচ্ছে; কেউ হোম বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছে; কেউ আইসোলেশনে আছে এবং অল্প সংখ্যক ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, করোনাকালের এই পরিস্থিতি আমাদেরকে মানসিকভাবে চাপে ফেলতে পারে বা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিভিন্ন রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন-  

১. ভয়, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগঃ এই সময়ে নিম্নোক্ত বিষয়ে আপনার মধ্যে ভয় বা দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ তৈরি হতে পারে-
-    আপনার নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে
-    অন্যদের স্বাস্থ্য নিয়ে কারণ যদি তাদের কারণে আপনি কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হোন
-    আপনার সংস্পর্শে আসার ফলে আপনার পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধব যদি আক্রান্ত হয়
-    কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণের দিকে নিজের দ্বারা বা অন্যদের দ্বারা মনিটরিং-এর অভিজ্ঞতা
-    কতদিন কাজ বা ব্যবসা বা চাকুরি থেকে দূরে থাকতে হবে এবং এর ফলে আর্থিক ক্ষতি বা চাকুরি নিয়ে অনিশ্চয়তা 
-    প্রয়োজনীয় খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও অন্যান্য ব্যক্তিগত সামগ্রী ক্রয় বা সংগ্রহ করার চ্যালেঞ্জ 
-    দৈনন্দিন খাবার (যেমন চাল, ডাল, আটা, পেয়াজ, তেল) বা চিকিৎসা সামগ্রী (মাস্ক, গ্লাভস বা হ্যন্ড স্যানিটাইজার) বা চিকিৎসা সেবা ইত্যাদির অপর্যাপ্ত সরবরাহ
-    পরিস্থিতি সম্পর্কে অপর্যাপ্ত তথ্য যেমন- স্বাস্থ্য বিভাগের কোভিড -১৯ রোগ সম্পর্কে দেরিতে তথ্য দেয়া,  তথ্যের অসম্পূর্ণতা বা অস্বচ্ছতা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় বা দপ্তরের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা   
-    নিজে বা পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে সঠিক ও কার্যকর যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের সক্ষমতা নিয়ে

২. কতদিন এরকম লকডাউন (বা কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন) থাকবে বা থাকতে হবে এবং ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বা হতাশা কাজ করতে পারে।

৩. সবকিছু থেকে বা অনেক প্রিয় মানুষজন থেকে দূরে থাকার ফলে আপনার মধ্যে একাকীত্বের অনুভূতি তৈরি হতে পারে।

৪. যারা লকডাউন বা কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তাদের প্রতি অথবা অন্যদের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলা বা অবহেলা বা অযত্নের ফলে আপনি কোভিড-১৯ রোগের বা এই অবস্থার শিকার তাহলে তাদের প্রতি আপনার রাগ বা বিতৃষ্ণা তৈরি হতে পারে।

৫. আপনি যেহেতু দীর্ঘদিন যাবৎ আপনার নিয়মিত বা দৈনন্দিন কাজ করতে পারছেন না ফলে আপনার মধ্যে একঘেয়েমি এবং হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। 

৬. এই পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য কারো কারো মধ্যে ধূমপান, তামাকজাত দ্রব্য, অ্যালকোহল বা অন্য কোন নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহনের আকাঙ্খা তৈরি হতে পারে। 

৭. আপনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন বা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে এসে থাকেন তাহলে অন্যদের দ্বারা বৈষম্যমূলক আচরণ পাবার ভয় কাজ করতে পারে। কারণ তারা ভাবতে পারে আপনার সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখলে তারাও সংক্রমিত হতে পারে।

৮. এই সময় কারো কারো মধ্যে বিষন্নতার বিভিন্ন লক্ষণ যেমন- নৈরাশ্য বোধ, কর্মস্পৃহা কমে যাওয়া, ক্ষুধা বা ঘুমের পরিমান আগের থেকে অনেক বেড়ে বা কমে যাওয়া এবং ঘুম আসতে বা মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

৯. কারো কারো মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) এর কিছু লক্ষণ যেমন- অযথাই দূর্দশাগ্রস্থ ঘটনা মনে আসা, দুঃস্বপ্ন দেখা, চিন্তা ও মেজাজে পরিবর্তন আসা এবং সহজেই আৎকে বা চমকে উঠা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

১০. যারা আগে থেকে শারীরিক বা মানসিক রোগে ভুগছে তাদের কারো কারো শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে পারে।

১১. অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে কারো কারো মধ্যে বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে যেমন-মাথা ব্যাথা, শরীরে বা পেটে ব্যাথা অনুভব করা ইত্যাদি।

যদিও এখন পর্যন্ত লকডাউন, সোশ্যাল ডিসটেন্সিং, কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন অবস্থায় থাকার ফলে সৃষ্ট মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কি হবে তা নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা খুবই কম বা নাই বললেই চলে, তারপরও কিছু গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান যথা-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন, সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-সিডিসি, এবং সাবস্টেন্স এবিউজ এন্ড মেন্টাল হেলথ সার্ভিসেস এডমিনিস্ট্রেশন – এর পরামর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশে যারা এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাড়িতে আছেন বা লকডাউন বা কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন অবস্থায় আছেন তারা কি কি পন্থা অবলম্বন করতে পারেন তা তুলে ধরছি-   

১. ঝুঁকি সম্পর্কে স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা রাখুন  
আমাদের অনেকের সংক্রামক রোগ যেমন কোভিড-১৯ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের আপনজনের বাস্তব স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে দুইভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারিঃ  
-    গুজবে কান না দিয়ে কোভিড-১৯ রোগ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পেতে নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য সূত্র  যেমন-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (www.who.int), সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-সিডিসি (www.cdc.gov), জাতীয় করোনা বাতায়ন (www.corona.gov.bd), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (www.dghs.gov.bd) বা আইইডিসিআর (www.iedcr.gov.bd) থেকে খবরা খবর রাখুন।
-    প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক-সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে সবসময় সজাগ থাকুন। তবে করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশি তথ্য, সংবাদ বা ভিডিও দেখলে যাদের দুশ্চিন্তা বা অস্থিরতা বেড়ে যায় তাদের সারাক্ষণ এ সম্পর্কিত সংবাদ দেখা বা শোনা থেকে বিরত থাকতে হবে।

২. নিজেই নিজের সহযোগী হোন 
যদি আপনি কোন হাসপাতাল বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন অবস্থায় না থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনি আপনার মৌলিক চাহিদা বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বা চিকিৎসা সামগ্রী কিভাবে সংগ্রহ করবেন তা ঠিক করুন। এক্ষেত্রে কেউ লকডাউন বা হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় থাকলে আপনার পরিবার, প্রতিবেশি, এলাকার স্বেচ্ছাসেবী এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে মোবাইল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে পারেন।

৩. নিজে নিজে শিখতে বা জানতে আগ্রহী হোন
কোভিড-১৯ রোগ সম্পর্কিত তথ্য, কোথায় এই রোগের পরীক্ষা হচ্ছে বা কোথায় এর চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে সে সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানুন। যেমন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন ব্রিফিং এর মাধ্যমে বা তাদের ওয়েবসাইটের  মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগের আক্রান্তের তথ্য দিচ্ছে। এছাড়া সারাদেশে ১৭ টি পরীক্ষাগারে করোনা পরীক্ষা চলছে এবং রাজধানীতে ১১ টি ও রাজধানীর বাইরে প্রত্যেক বিভাগীয় হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা সেবার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কোভিড-১৯ রোগ সম্পর্কিত তথ্য বা চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতে কোন ভয় পাবেন না। প্রয়োজনে পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধবদের জিজ্ঞাসা করে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে রাখুন।  

৪. নিয়োগকর্তার সাথে যোগাযোগ রাখুন
করোনাকালে আপনি যেহেতু কাজে যোগ দিতে পারছেন না, তাই আপনার নিয়োগকর্তা বা উর্ধতন কর্মকর্তাকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে বলেন ঠিক কী কারণে আপনি আসতে পারছেন না। কারণ হিসেবে সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের কথা বলতে পারেন অথবা আপনি যদি কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন-এ থাকেন তাও সঠিকভাবে জানান। এছাড়া আপনার যদি এই পরিস্থিতিতে জীবনযাপনের ব্যয় পরিচালনা করতে খুব সমস্যা হয় তাহলে সেই সমস্যা বা কষ্টের কথাগুলোও আপনার নিয়োগকর্তা বা উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে শেয়ার করুন। এর ফলে হয়তো আপনার  আর্থিক সমস্যা সমাধানে আপনার অফিসের কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে। তারপরও যদি আর্থিক সমস্যা না  কাটে, সেক্ষেত্রে আপনার আর্থিক অবস্থার কথা ভাড়াটিয়া হলে আপনার বাসার মালিক এবং ইউটিলিটি প্রোভাইডার (ডিস ও ইন্টারনেট সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠান) কে জানান এবং মাসিক বিল দিতে দেরি হবে কিনা বা বিকল্প কোন পদ্ধতিতে দিবেন তা আপনি স্পষ্টভাবে তাদেরকে জানান। 

৫. অন্যদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখুন
করোনাকালে আপনার পরিচিত, প্রিয় ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারলে (বা শেয়ার করতে পারলে) আপনার একঘেয়েমি, একাকীত্ব, উদ্বেগ ও বিষন্নতাবোধ অনেকটাই কমে যাবে। এক্ষেত্রে আপনি মোবাইল, টেলিফোন, ই-মেইল, মেসেজিং, চ্যাটিং, ফেসবুক বা অন্য কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আপনার বন্ধু, পরিবারের সদস্য, আত্নীয়-স্বজন, সহকর্মী এবং পরিচিতজনদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন। প্রিয় মানুষ বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে প্রয়োজনে স্কাইপে, ইমো, ভাইভার বা হোয়্যাটসঅ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে ভিডিও কল করে ফেইস-টু-ফেইস কথা বলতে পারেন। আপনি যদি কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন-এ থাকেন তাহলে আপনার স্বাস্থ্যসেবাদানকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আপনার বন্ধু, প্রিয়জন বা স্বেচ্ছাসেবকের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন এবং প্রয়োজনে তাদের মাধ্যমে আপনার পত্রিকা, বই, সিনেমা, নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ব্যক্তিগত সামগ্রী আনাতে পারেন। রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের অন্যান্য ঘটনাগুলো জানার চেষ্টা করুন। 

৬. চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ রাখুন
আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ যদি আইসোলেশন বা হাসপাতালে ভর্তি থেকে থাকেন, তাহলে আপনি  চিকিৎসককে হাতের নাগালেই পাবেন এবং তিনি আপনার বা আপনার পরিবারের সদস্যের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু আপনি যদি লকডাউন বা হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় থাকেন, তাহলে আপনি বা আপনার পরিবারের কোন সদস্য শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থবোধ করলে অবশ্যই চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রাখুন। এক্ষেত্রে আপনি প্রথমেই আপনার বা আপনার পরিবারের সদস্যের  নিয়মিত চিকিৎসকের সাথে বা নিকটস্থ হাসপাতালের চিকিৎসকের সাথে মোবাইল, ই-মেইল, ফেসবুক বা স্কাইপের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আপনার বা আপনার পরিবারের সদস্যের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানান এবং পরামর্শ গ্রহন করুন। যদি কোন চিকিৎসককের সাথে যোগাযোগ করতে না পারেন সেক্ষেত্রে ঘরে বসে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে কিছু সরকারি হটলাইন নম্বর যেমন-৩৩৩ বা ১৬২৬৩ বা ১০৬৫৫ বা ০১৯৪৪৩৩৩২২২ ইত্যাদি নম্বরে কল করুন।

৭. দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করুন এবং তা মেনে চলুন
এই মুহুর্তে আপনার অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সন্তানের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবই বন্ধ থাকায় যেহেতু পুরো সময়টা বাসায় কাটাচ্ছেন, তাই বাসায় আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্যদের সবার জন্য একটি দৈনন্দিন কাজের রুটিন তৈরি করুন। এই রুটিনে বিভিন্ন কাজ অন্তর্ভূক্ত করতে পারেন যেমন-সকালে ঘুম থেকে উঠার সময়, রাতে ঘুমাতে যাবার সময়, খাবার-দাবার করার সময়, আপনার অফিসের কোন কাজ, সবাই মিলে বাসার বিভিন্ন কাজ (রান্না-বান্না করা, বাসা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও কাপড়-চোপড় ধৌতকরণ) করা, সন্তানকে পড়াশুনা করানো, সন্তানের বাসায় খেলাধূলার ব্যবস্থা করা, ব্যায়াম করা, নামাজ পড়া বা প্রার্থনা করা, বিশ্রাম নেয়া এবং টিভি দেখা ইত্যাদি।   

৮. স্বাস্থ্যকর জীবনাভ্যাস মেনে চলুন
করোনাকালের এই সময়ে যেহেতু আমরা বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছি, তাই আমাদের সবার উচিত স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা। এই সময় আপনার উচিত সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন করা, পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং হাল্কা ব্যায়াম করা। কিন্তু মানসিক চাপ দূর করার চেষ্টা করতে গিয়ে কখনোই ধূমপান, তামাকজাত দ্রব্য, অ্যালকোহল বা অন্য কোন নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহন করবেন না। বরং বাসায় পরিবারের সদস্যদের সাথে ভালো সময় কাটান, নিজেরা গল্প করুন, একে অপরকে সহায়তা করুন এবং বাইরের বন্ধু বা স্বজনদের সাথে মোবাইল, ই-মেইল, ফেসবুক বা অন্য কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করুন। 

৯. প্রযোজ্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন
এই পরিস্থতিতে সরকার কর্তৃক প্রচারকৃত বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি আপনি ও আপনার পরিবারের সদস্যরা মেনে চলুন। যেমন-বারবার সাবান-পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড যাবৎ হাত পরিস্কার করা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা, ঘরে থাকা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা ইত্যাদি।

১০. নিজেকে ব্যস্ত রাখুন
এই সময় চলমান করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে আপনার পছন্দনীয় ও আনন্দদায়ক কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন যা এতদিন সময়ের অভাবে করতে পারেননি। যেমন-আপনার একটি প্রিয় সিনেমা দেখতে পারেন, পছন্দের গান শুনতে পারেন, প্রিয় একটি বই পড়তে পারেন, অন্যদের সাথে ফান করুন, শখের কাজগুলো করতে পারেন, বাগানের যত্ন নিতে পারেন, সন্তানের সাথে বিভিন্ন খেলা খেলতে পারেন, সৃজনশীল কোন কাজ করতে পারেন, বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মকান্ড (নাচ, গান, আবৃতি) করতে পারেন, অনলাইনে ফিটনেস প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করতে পারেন এবং অনলাইনে বিভিন্ন দক্ষতা শেখার প্রশিক্ষণ নিতে পারেন ইত্যাদি।    

১১. নিজের ওপর আস্থা রাখুন
অতীতে এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যবহৃত আপনার দক্ষতাগুলোর কথা আবার মনে করুন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সময় আপনার মানসিক চাপ কমাতে পূর্বের দক্ষতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করুন।

১২. অন্যকে সহায়তা করুন
কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের ফলে সাধারণ ছুটি বা লকডাউন বা প্রশাসনের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকল্পে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাই আপনার সাধ্যমতো আপনার স্বজন, প্রতিবেশি ও আশেপাশের পরিচিত বা অপরিচিত দুস্থ, অসহায়, গরীব ও কর্মহীন মানুষদের আর্থিকভাবে সহায়তা করুন। এছাড়া আপনি তথ্য দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, সচেতনতায় অংশ নিয়ে বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও অন্যদের সহায়তা করতে পারেন। এর ফলে আপনার মধ্যে একধরণের ভালো লাগা কাজ করবে যে আপনি আপনার সমাজ বা দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছেন।

১৩. দুর্যোগ মোকাবেলায় যারা কাজ করছে তাদের প্রতি সম্মান ও ভালবাসা প্রদান করুনঃ
করোনা ভাইরাসের চলমান সংক্রমণের সময় এর চিকিৎসায় নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেসব চিকিৎসক, নার্স বা স্বাস্থ্যসেবাকর্মী জড়িত তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন এবং বাহ্‌বা দিন যাতে করে   তারা কাজে অনুপ্রাণিত হয়। এছাড়া মাঠপর্যায়ের প্রশাসন, পুলিশ সদস্য, সামরিক বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, সমাজ  সেবক এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক যারা এই দুর্যোগে দিন-রাত সরকারি বা সেবাদানে কাজ করে যাচ্ছে তাদের প্রতিও  সম্মান প্রদর্শন করুন এবং তাদেরকে কাজে উৎসাহিত করুন।

১৪. শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিন এবং তাদেরকে সঠিক তথ্য দিন
যেহতু এই সময় শিশুর স্কুল বন্ধ তাই সে কীভাবে দিন কাটাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখুন। তার একটি দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করে দিন। তার আচরণ পর্যবেক্ষণ করুন। তার শারীরিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখুন। তার সাথে আগের চেয়ে একটু বেশি সময় কাটান। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। এই সময় সে পরিবারের বড় সদস্যদের আলাপ-আলোচনা শুনে ভয় পেয়ে যেতে পারে তাই তার সামনে বেশি আলোচনা না করে বরং তাকে আশ্বস্ত করুন এবং শান্ত রাখুন। তাকে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিন। এই রোগ থেকে রক্ষা পেতে কি কি স্বাস্থ্যবিধি আছে সেগুলো শিশুর সাথে শেয়ার করুন যেমন- বাচ্চাদের বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলু্‌ন; তারা যাতে হাত দিয়ে নাক, চোখ বা মুখে স্পর্শ না করে তা বলুন; হাঁচি-কাশি দেয়ার শিষ্টাচারগুলো শেখান ইত্যাদি। কোভিড-১৯ রোগে শিশু বা পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে শিশুকে তার বয়স ও বিকাশ অনুযায়ী তথ্য দিন এবং তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখুন। 

১৫. একাধিক রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি খেয়াল রাখুন
এই পরিস্থিতিতে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তি যিনি একাধিক রোগ যেমন-শ্বাসকষ্ট, কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগে ভুগছেন তার প্রতি বিশেষ নজর দিন কারণ কোভিড-১৯ রোগের ক্ষেত্রে  সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন এই ব্যক্তি। বর্তমানে এই রোগের ফলে কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে সাধারণ তথ্য শেয়ার করুন এবং কীভাবে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করা যায় সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা দিন। তার সাথে অন্যান্য  বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। তার প্রয়োজনীয় ঔষধ সংরক্ষণে রাখুন এবং তাকে নিশ্চিত করুন। তার একটি দৈনন্দিন কাজের রুটিন তৈরি করে দিন এবং তা মেনে চলতে পারছেন কিনা তা খেয়াল করুন। তার সুষম খাবার, পর্যাপ্ত পানি সেবন, পরিমিত ঘুম এবং সাধারণ শরীরচর্চার দিকে নজর দিন।  

১৬. মানসিক চাপ মোকাবেলায় ইতিবাচক থাকুন এবং মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল ব্যবহার করুন
এই পরিস্থিতিতে নেতিবাচক বিষয়গুলোতে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে সেগুলো অতিরঞ্জিত করে তুলবেন না। বরং এই মুহূর্তে যা করা সম্ভব সেটি করুন এবং যেটি পরিবর্তন করা সম্ভব নয় তা মেনে নিন। এছাড়া এই সময় বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল যেমন-মেডিটেশন, মাইন্ডফুলনেস, রিলাক্সেশন (ডিপ ব্রেথিং, মাসকুলার রিলাক্সেশন ও পজিটিভ ইমেজারি) ইত্যাদি করার চেষ্টা করতে পারেন। ইউটিউবে এই কৌশলগুলোর অনেক দেশি-বিদেশি ভিডিও আছে যেগুলো দেখে আপনি নিজে নিজে অনুশীলন করতে পারেন। 

১৭. অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা যন্ত্রণা বোধ করলে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করুন
কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের এই সময়ে আপনি বা আপনার স্বজন কারো মধ্যে যদি অতিরিক্ত মানসিক চাপের অথবা বিষন্নতার বিভিন্ন লক্ষন যেমন-ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধা খুব বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, দৈনন্দিন কাজ নির্বাহ করতে না পারা এবং অ্যালকোহল বা অন্য নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি আসক্ত হওয়া ইত্যাদি দেখা যায়, তাহলে দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন পেশাজীবি যথা-মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক এর সাথে মোবাইল বা অনলাইনে যোগাযোগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রনালয়, বিএসএমএমইউ, ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মনোচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী (চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানী), সাইকোথেরাপিস্ট  ও ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার –দের বিভিন্ন সমিতি বা সংগঠন বা কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে বিনামূল্যে মোবাইলে বা অনলাইনে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা বা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
পরিশেষে আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে করোনাকালের এই সময়টা সাময়িক; এই পরিস্থিতি আমাদের সবার চেষ্টায় হয়তো নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে। নিশ্চয়ই আমরা সবাই আবার স্বাভাবিক জীবনে দ্রুত ফিরে আসবো। তবে করোনাকাল শেষ হয়ে যাবার পরও অনেকের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে যা সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। অতএব সেই ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের উচিৎ আগে থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী পেশাজীবী ও গবেষকদের সাথে  আলোচনা করে আগাম প্রস্তুতি গ্রহন করা।   

লেখক পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
mdshaheenmollah@gmail.com

আরও পড়ুন

×