১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুললে এর প্রবল বিরোধিতা করেন পূর্ব বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন। সে বছরের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।' তার সেই ঘোষণায় বাঙালি ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এই আন্দোলনের মধ্যেই ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন এক ভাষণে জিন্নাহর কথারই পুনরুক্তি করেন। তার এই বক্তব্য ছাত্রদের আন্দোলনে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়। এরপর সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সভা-সমাবেশের ডাক দেয়। প্রশাসন ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা ভেঙেই ছাত্রজনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলিত হতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউরসহ অনেকে নিহত হন। মূলত খাজা নাজিম উদ্দীনের নির্দেশেই পুলিশ এই হত্যাযজ্ঞ চালায় বলে ধারণা করা হয়। অথচ রাষ্ট্রভাষা বাংলার শত্রু ঘৃণ্য সেই নাজিম উদ্দীনের নাম গত ৬৮ বছর ধরে ঈশ্বরদীবাসী বয়ে বেড়াচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরদীর জিন্না কলেজের নাম পরিবর্তন করে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ঈশ্বরদীর একাধিক প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হয়েছে। অথচ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধাচরণ করা সেই খাজা নাজিম উদ্দীনের নামে ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত 'বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি নাজিম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়' আজও বহাল তবিয়তে আছে। একাধিকবার এই স্কুলের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে জন্মেছে ক্ষোভ ও হতাশা। এবার অন্তত এই ভাষার মাসে স্কুলটি থেকে নাজিম উদ্দীনের নাম  অপসারণের জোরালো দাবি তুলেছেন তারা।

তথ্যসূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই বিদ্যালয়টিতে ঈশ্বরদীতে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ছেলেমেয়েরাই শুধু পড়ালেখা করত। ঈশ্বরদী পৌর এলাকার বিহারি অধ্যুষিত বিহারিপাড়া ও ফতেমোহাম্মদপুর এলাকায় বসবাসকারী বিহারিদের সন্তানদের পাশাপাশি এখানে কিছু বাঙালি ছেলেমেয়েও ভর্তি হয়। বর্তমানেও স্কুলটিতে বিহারি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি।

'ঈশ্বরদীর ইতিহাস' বইয়ের লেখক মুক্তিযোদ্ধা কামাল আহমেদ জানান, ১৯৫২ সালে ঈশ্বরদীর অবাঙালিরা লোকো রোডে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বিশালাকার রেলওয়ে রানিংরুমে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনের নামে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি নাজিম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠা পায়। স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে স্কুলটির বিশাল ভবনের বেশিরভাগ অংশই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বর্ধিত অংশের ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। ছাদের নিচে পলেস্তারা খসে পড়ে ঢালাইয়ের রড বের হয়ে পড়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে বসে পড়ালেখা করলেও আশঙ্কার মধ্যে থাকে।

ঈশ্বরদী নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, ঈশ্বরদী নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করার দাবি জানানো হয়েছিল, কিন্তু এখনও নাম পরিবর্তন করা হয়নি। ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের উদ্যোগে গত ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় প্রস্তাব আকারে সরকারের কাছে এই স্কুলের নাম পরিবর্তনের দাবি জানানো হয়েছে বলে জানান প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বপন কুমার কুণ্ডু।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খন্দকার মো. আব্দুর রহমান জানান, বর্তমানে এই স্কুলে ৩৩৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে, যার অধিকাংশই অবাঙালি। তবে স্কুলটিতে শিক্ষক-কর্মচারী মিলিয়ে ২৭টি পদের বিপরীতে এখানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১১ জন। মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান ফান্টু বলেন, এর আগে জিন্না কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ খাজা নাজিম উদ্দীনের নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির নাম এখনও রয়ে গেছে, যা ঈশ্বরদীবাসীর জন্য খুবই অসম্মানজনক। উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা চান্না মণ্ডল বলেন, আমরাও এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) আসাদুল হক এ প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনার মাধ্যমে জানতে পেরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান রেখে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিহাব রায়হান বলেন, ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই স্কুলের নাম পরিবর্তনের জন্য রেলওয়ের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে।