আমরা পৃথিবীর মানুষ আজ ভালো নেই। করোনাভাইরাসের কারণে যাবতীয় হিসাব নিকাশ উল্টে যেতে বসেছে। মানুষ আজ ঘরবন্দী। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। লকডাউনে মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হলেও ঘরে ধরে রাখা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানানো যাচ্ছে না। উল্টো আমরা দেখছি ত্রাণ চুরি, দুর্নীতি, অনিয়ম। কিন্তু কেন? অনেকে অনেক কথা বলছেন। কিন্তু সমস্যা আরও গভীরে। আমাদের উপলব্ধিতে ঘাটতি রয়েছে। সত্যিকার অর্থে মানুষ শুধু নিজের জন্য বাঁচে না; তাকে বাঁচতে হয় অন্যের জন্যও। কিন্তু এই সহজ ও সাধারণ সত্যের সাথে আমরা কতটা পরিচিত?

ক'জন মানুষকে জীবনে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সদাচরণের চর্চা করতে হয়। এই চর্চার পরিবেশ সমাজে কতটা বিদ্যমান। বিষয়টি এভাবে বলতে হবে যে, একজন শিশু একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু তাকে বড় হতে প্রয়োজন পড়ে একটি সমাজের। শিশু পরিবার থেকে ক্রমশ সামাজিক নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে। সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তথা স্কুল, কলেজ, বিশ্বাবিদ্যালয়, ক্লাব, সংঘ ইত্যাদিতে নৈতিক, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের চর্চার ব্যবস্থা থাকা চাই।

বাংলাদেশের সমাজিক জীবনে এই নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি দেখছি আমরা। অতীত বলে এই সমাজের মানুষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য মানবিকতার দৃষ্টান্ত। তাছাড়া বাংলাদেশ তথা বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। অতিথিপরায়নতাও এই সমাজের ঐতিহ্য। কিন্তু এখন যেন সব বদলে গেছে। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করছে না। অপরকে ঠকিয়ে নিজে জেতা যে জেতা নয় বরং দীর্ঘদিনের জন্য হেরে যাওয়া- এটা বুঝতে পারছে না মানুষ। মানুষের এই চিন্তা ও আচরনের নেতিবাচক পরিবর্তনের পেছনের কারণ জানা জরুরি। 

অন্য অনেক কারণ নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমার বিবেচনায় মূল সমস্যা আসলে আমাদের মানুষ তৈরির যে কারখানা রয়েছে গলদ মূলত সেখানেই। মানুষ তৈরির কারখানা মূলত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। মানবসন্তান বা শিশু জন্মের পরপরই কিন্তু পরিপূর্ণ মানুষ নয়। তাকে মানুষ হয়ে ওঠার জন্য একটি দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়। এই যে বেড়ে ওঠা কিংবা মানুষ হয়ে ওঠার সময়টাতেই তার মধ্যে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ধারণা এবং চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত না করা গেলে, সে বড় হয়ে উঠবে ঠিকই কিন্তু মানুষ হয়ে উঠবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। মানুষের মত দেখতে হলেও মানুষ সম্পর্কে এই কথাটি আজকাল খুব বেশি শুনতে পাওয়া যায় ‘মানুষ আর মানুষ নেই, অমানুষ হয়ে গেছে’। এ কথাটিই প্রমাণ করে যে, আমাদের সন্তানেরা বড় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কতটা মানবিক হয়ে বেড়ে উঠছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এজন্য আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তার শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, পাঠ-ব্যবস্থাপনা, কলাকৌশল ও মূল্যায়ন ব্যবস্থায় সংস্কার অপরিহার্য। কেননা আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে এখন আর নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের না আছে পরিবেশ, না আছে চর্চা। এখন বিদ্যালয়গুলোতে মূলত যা চর্চা করানো হয়; তা হলো পরীক্ষাকেন্দ্রিক মূল্যায়নে অধিক নম্বর তোলার কৌশল চর্চা। মোট কথা বেশি নম্বর পেতে হবে, তা যেকোনো উপায়েই হোক। এখন আর শিখনটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; যতটা পরীক্ষায় অধিক নম্বর প্রাপ্তির বিষয়টি গুরুত্ব পায়। 

শিক্ষার মূল দর্শন হলো মনুষত্বের বিকাশ ও অপরাপর মানবের কল্যানকর বিষয়ের অন্বেষণ এবং আবিষ্কার। আবিষ্কার হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেই সকল অবিষ্কারের ব্যবহার এবং এর প্রভাব কতটা অপরাপর মানবের জন্য কতটুকু কল্যাণকর সেই দিকটি উপেক্ষিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আর এমনটি হচ্ছে কেন? এর প্রধান কারণ হলো শিশুর বেড়ে ওঠার সময়কাল থেকে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ধারণা প্রদানের অভাব এবং ব্যক্তি জীবনে এগুলোর চর্চা না থাকা। ফলে শিশু থেকে পরিণত বয়সে এসেও তার মধ্যে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অভাব থেকে যাচ্ছে। সুস্থ ও সুন্দর মানবিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে সহায়ক বিষয়গুলো যুক্ত করার পাশাপাশি সেগুলোর চর্চার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আর এটা সম্ভব শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, পাঠ-ব্যবস্থাপনা ও কৌশল এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে। আর এটা শুরু করার এখনই সময়।

লেখক: শিক্ষা উন্নয়নকর্মী