করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও লকডাউন ঘোষণা করেছে, যা সাধারণ ছুটি নামে দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে। পশ্চিমা ধারার শব্দ লকডাউনের সঙ্গে বাংলাদেশের জনসাধারণের পরিচিতি নেই বললেই চলে। আমরা সাধারণত হরতাল, অবরোধ, কারফিউ, ১৪৪ ধারা— শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত। এরমধ্যে হরতাল বিরোধী দলের রাজনৈতিক হাতিয়ার হওয়ায় সরকারপন্থীসহ আরও অনেকের মধ্যে হরতাল না মানার চিত্র লক্ষ করা যায়। কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা সরকার বা প্রশাসনের অস্ত্র। সরকারি অস্ত্রের শক্তি বেশি বলে লোকজন ভয় পায়। এই ভীতি থেকে লোকজন ঘরে বসেই সময় কাটায়। দেশীয় চেনা-জানা শত্রু বাঙালির মনের ভেতর যতোটা ভয় জাগাতে পারে; বাঙালি বিদেশিকে সেই অর্থে ততোটা ভয় পায় না। এজন্য কোনো বিদেশি শক্তি বাঙালির মনে চিরস্থায়ী ভীতির কম্পন জাগাতে পারেনি।

লক্ষণীয়, ‘লকডাউন’, ‘আইসোলেশন’, ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’— এই তিন বিদেশি শব্দ বাঙালির কাছে বিশেষ পাত্তা পায়নি। লকডাউনের বাংলা পারিভাষিক শব্দ ‘অবরুদ্ধ’। দেশীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির কল্যাণে ‘অবরোধ’ শব্দের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় আছে। অনেকে মনে করেন যে, সরকার কর্তৃক ‘অবরোধ’ শব্দটি প্রচার-প্রচারণা চালালে হয়তো ভালো হতো। ‘হয়তো’ বললাম এ জন্য বাঙালির দায়িত্ব-সচেতনতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন আছে। এছাড়া স্বঅবরোধে বাঙালি অভ্যস্ত নয়। অবরুদ্ধ বলতে বাঙালির মানসপটে ভেসে উঠে সরকারি বাহিনী কর্তৃক বিরোধী শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অফিস বা বাসা থেকে বাইরে বের হতে না দেওয়ার দৃশ্য, সেটি রাস্তায় বালু ভর্তি ট্রাক রেখে দিয়ে হলেও। বাঙালি স্বেচ্ছায় ঘর থেকে বের হবে না, এটা কোনো কথা নাকি! তাহলে তো পেটের ভাত-ই হজম হবে না। আমরা সবাই এমন মানসিকতার না, এটা সত্য। তবে অধিকাংশই এমন, এটা আরো সত্য। এ কারণেই আমরা লকডাউনের সময়ে গণ পরিবহণ মুক্ত ফাঁকা রাস্তায় ঢাকা দর্শনে বের হই কিংবা সবজি কেনাকে পুজি করে মনের আনন্দে ঢাকার রাজপথে ঘুরে বেড়াই। কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালতের দৃষ্টিতে পড়লে হামেশা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে বের হয়ে যাই।

আমাদের মনে আছে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের কথা জানানো হয় ৮ মার্চ। আমরা জেনেছি যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর কিছু উপসর্গ লক্ষ করা গেলেও কোনো উপসর্গের লক্ষণ ছাড়াও এ রোগী থাকতে পারে। অতিক্ষুদ্র এ ভাইরাসটি খালি চোখে দেখাও যায় না। কে আক্রান্ত বা আক্রান্ত না, তা কখনো কখনো দেখেও বুঝা যায় না। এমন কী আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথম দিকে নিজেও বুঝতে পারেন না। টেস্টের ওপর এ রোগী শনাক্ত নির্ভর করে। এখন দিন যতো গড়াচ্ছে, টেস্টের সংখ্যা ততো বাড়ছে এবং একই সঙ্গে রোগী বাড়ার সূচকও উধ্বমুখী রয়েছে। 

সরকার করোনা বিস্তাররোধে ২৬ মার্চ থেকে প্রথম দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এরআগে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব স্কুল–কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকারের এই ঘোষণায় তৈরি পোষাক কারখানারও লাখ লাখ কর্মী ছুটি পান। সরকারের পক্ষ থেকে এই ছুটির উদ্দেশ্য হিসেবে অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায় করোনা ব্রিফিংয়ে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে লক ডাউনের সাধারণ ছুটিতে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মাত্র এক সপ্তাহের ছুটিকে আমরা গ্রামের পানে ঈদ যাত্রা বানিয়ে ফেলি। ফলে যাকে নিয়ে এতো ভয়, সেই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবার ঠেকায় কে! অতএব, যা হবার, তাই হলো।

সরকার এখন লকডাউন কিছুটা শিথিল করেছে। শর্ত সাপেক্ষে ঈদের কেনাকাটার জন্য বিপণিবিতানগুলো ১০ মে থেকে সীমিত আকারে খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরআগে সীমিত পরিসরে তৈরি পোশাক কারখানাও খুলে দেয়া হয়। অধিক সংখ্যক মুসল্লিদের জন্য মসজিদ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে ঈদে বাড়ি যেতে বারণ করে দুরপাল্লার বাস বন্ধ-ই রাখা হয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। সরকারের শরিক জাসদ (ইনু) এবং ওয়াকার্স পার্টি থেকে এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয়েছে। বিপণিবিতান খোলা নিয়ে খোঁদ ব্যবসায়ীদের মধ্যে মত পার্থক্য জানান দেওয়া হয়েছে। অনেক বিপণিবিতান খুলেনি। সিপিডি’র ফেসবুক জরিপ অনুযায়ী ৯৩ শতাংশ মানুষ বিপণিবিতান খোলার বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে সরকার লকডাউন শিথিল করলো কার চাপে বা কার স্বার্থে?

আমরা জেনেছি যে, সুইডিস সরকার করোনা মোকাবেলায় সেখানে লকডাউন ঘোষণা করেনি। কারণ, সুইডিসরা নিজেরাই সচেতন। তারা নিজ থেকেই অপরজন থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। আমরা সুইডিসদের মতো নই। পিঠে লাঠির বাড়ি না পড়া পর্যন্ত আমরা কথা শুনতে অভ্যস্ত নই।

দীর্ঘ সময় ধরে সব কিছু বন্ধ রাখা যায় না। অনেক দিন ধরে ঘরে থাকার মানসিকতাও সবার মধ্যে নেই। নেই সক্ষমতাও। বিগত দেড় মাসে লোকজনের মধ্যে অনেকের ঘরে খাবার নেই। তারা মানুষের কাছে হাত পাততে বাধ্য হচ্ছে। আমি যেখানে বসবাস করি সেখানে লকডাউন পুরোপরি কার্যকর। আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী লোকজনেরই রাস্তায় হাঁটাচলা নিষেধ। বাইরের লোকজনের সেখানে যাওয়ার সুযোগই নেই। এই অবস্থার মধ্যেও নিরাপত্তার কর্মীদের চোঁখ ফাকি দিয়ে বেশ কয়েক দিন নতুন সাহায্যপ্রার্থী মহিলাদের দেখা মিলেছে। তারা জানিয়েছে, তারা ফকির না, কিন্তু ঘরে কোনো খাবার নেই। তারা সরকারি, বেসরকারি কোনো সাহায্যও পাননি। গৃহকর্মীর কাজ করতেন। এখন সেই কাজ নেই। ছোট্ট ছেলে-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে আছেন। ধমক খাওয়ার ভয়ে বুদ্ধি করে তারা কেউ সিড়িতে উঠেনি। নীচ থেকেই সাহায্যের আশায় ডাকাডাকি করেছিল। এই নতুন হাত পাততে বাধ্য হওয়া লোকজনের জন্য লকডাউন শিথিল করা জরুরি, যা করোনার বিস্তার রোধে বেমানানও বটে। জীবন আগে না জীবিকা আছে- এ প্রশ্নের যুৎসই উত্তর হবে একটি অপরটির পরিপূরক। ক্ষুধার জ্বালায় যে মরতে বসেছে, করোনা তাকে কী মারবে? আবার জীবিকা আছে এবং পেটে খাবারও আছে, ধরেছে করোনায়, তখন কী হবে? এই দুইয়ের মাঝে সমন্বয় করতে পারে নিজ থেকে সচেতন হওয়া, যা আমাদের স্বভাবে নেই বললেই চলে। যাতে পেটের পীড়া না হয়, সেজন্য সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ইউনিসেফের মীনা কার্টুনের শিক্ষাটা আমরা এখনও শিখছি যা, এই সময়ে জোরদার হয়েছে মাত্র। 

জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হলেও জনঘনত্বের দিক থেকে বিশ্বের প্রথম। বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১ হাজার ২৬৫ জন বসবাস করে, যা রশিয়া থেকে ১৪০ গুণ বেশি। অনেকেই বলেন যে, গরিবের প্রতি সৃষ্টিকর্তার দয়া বেশি। এ জন্য গরীবের অসুখ-বিসুখ কম হয়। আবার হলেও ঝাড়-ফুঁক, কবিরাজ এবং হাতুরে ডাক্তারদের চিকিৎসাতেই অনেকে ভালো হয়ে যায়। এর বিজ্ঞানভিত্তিক সমর্থন নেই। তাতে কী, হাল হকিকতে কিন্তু সেই স্বাক্ষই দেয়। তা না হলে বিশ্বের এক নম্বর জনঘনত্বের দেশে করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হওয়ার পর, মহামারি যেরূপে দেখা যাওয়ার কথা, সেই রূপটা এখনো দেখা মিলেনি। তবে তৃপ্তির ঢেকুর গিলার সময় এখনো আসেনি। আমরা যেভাবে চলাফেরা করছি, তাতে কে বলতে পারে যে, বীরদর্পে মহামারির স্বরূপটা দেখা দিবে না।

ইতিহাসের শিক্ষার্থী মাত্রই জানেন যে, মানুষের নিজেকে শোধরানোর বা শিক্ষা গ্রহণের দু’টি পথ আছে। ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস তার হিস্টোরিস গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেছেন, মানুষ তার নিজের দুর্ভাগ্যের দ্বারা শোধরায় বা শিখে। আর শোধরায় বা শিখে অপরের দুর্ভাগ্য দেখে বা শুনে। প্রথম শিক্ষাটি অনেক কষ্টের। দ্বিতীয়টি কম কষ্টবহ। কিন্তু মানুষের অতীত ইতিহাস এই স্বাক্ষ্য দেয় যে, মানুষ কম কষ্টবহ দ্বিতীয়টি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে প্রথমটি থেকে। করোনাকালে নিরন্ন মানুষের খাদ্যদ্রব্য যেসব জনপ্রতিনিধি আত্মসাৎ করেছে তারা অনেকেই জনপ্রতিনিধির নির্বাচিত পদ হারিয়েছে। কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছে। আবার এটাও সত্য যে, অনেকে আত্মসাৎ করেও অধরা আছে। হিরোডোটাসের তত্ত্ব অনুযায়ী যারা পদ হারিয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে, সম্মান খুইয়েছে, তারা এ  থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। ভবিষ্যতে হয়তো এ কলঙ্কের তিলক আর মাথায় নেবে না। আর যারা অধরা আছে, তারা অপরজনকে দেখেও শিক্ষা নেবে না। আবার যারা করোনাকালে বিনা কারণে ঘুরে বেড়ায়, ঈদের কয়েকদিনের ছুটিতে আবারও যারা ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, অটো রিকশা, নৌকা আর পায়ে হেটে আবারও বাড়ি যাবে, লকডাউন শিথিলের শৈথিল্যে টাকা-পয়সা আছে বলে ঈদের কেনাকাটায় বের হয়, এই ‘সুখে থাকতে যাদের ভূতে কিলায়’ তারা যদি করোনায় আক্রান্ত হয়, সেরে উঠলে তারা শিক্ষাটা গ্রহণ করবে। আর জীবন না বাঁচলে কিসের শিক্ষা, কোনো কথাই নেই। তাই, দিনশেষে একথা আবারও বলা যায় যে, অপরকে দেখে শিক্ষা গ্রহণ আমাদের ভেতর নেই।

লেখক ও গবেষক

asumanarticle@gmail.com