ক'দিন আগে সিএনএন-এ করোনাভাইরাস নিয়ে একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। তিনি এক পর্যায়ে বলছিলেন, বিশ্বব্যাপী করোনার বিস্তৃতি ঠেকাতে তিনটি পদ্ধতি বা অ্যাপ্রোচ প্রয়োগ করা হয়েছে। একটি হলো চীনা পদ্ধতি। এটির মূল কথা সম্পূর্ণ লকডাউন। নির্দিষ্ট জায়গায় কড়াকড়িভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করে নতুন সংক্রমণ যাতে না-ঘটে তা নিশ্চিত করা। ইতোমধ্যে যারা সংক্রমিত হয়েছেন তাদের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া। দ্বিতীয় অ্যাপ্রোচ হলো কোরিয়ান পদ্ধতি। এতে টেস্ট, টেস্ট আর টেস্টের ওপর জোর দেয়া হয়। টেস্টে রোগী চিহ্নিত করা হয়। সংক্রমিতদের আইসোলেশনে রাখা ও চিকিৎসা দেয়া হয়। তার মতে, তৃতীয় পদ্ধতি হলো আমেরিকান পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মূল কথা হলো, ‘নো পদ্ধতি’। কোনো সমন্বিত পদ্ধতি নাই। যে যেভাবে পারে, যার যা ইচ্ছা তা-ই করে। নিজের দেশের ক্রম-অবনতিশীল পরিস্থিতিতে তিনি ক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপ্রোচ সম্পর্কে এভাবে বলছিলেন। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক মানুষের মৃত্যু সত্ত্বেও লকডাউন ও টেস্টিং উভয় পথে তারা পরিস্থিত মোকাবিলা করছে। সবচেয়ে বড় কথা, যুক্তুরাষ্ট্র ইতোমধ্যে একটি ন্যাশনাল প্ল্যান প্রণয়ন করে সেটির ভিত্তিতে অগ্রসর হচ্ছে। তবে সিএনএন-এর ওইদিনের সাক্ষাৎকার ও আলোচনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউন ও সর্বোচ্চ সংখ্যায় টেস্টিং যে জরুরি তা সবাই স্বীকার করছিলেন।

গত ৯ মে ভারতের এনডিটিভিতে প্রণয় রায়ের উপস্থাপনায়  করোনাভাইরাস, এর সংক্রমণ, লকডাউন প্রত্যাহার, কোভিড ১৯-এর চিকিৎসা, ভবিষ্যতে চিকিৎসার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়। এতে আইবিএম-এর গ্লোবাল সিইও অরবিন্দ কৃষ্ণা, প্যারিস থেকে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর থমাস পিকেটে, অক্সফোর্ড থেকে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর স্যার পিটার র্যাটক্লিফ, মার্কিন রকফেলার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট রাজিব শাহ এবং চেন্নাই থেকে প্রফেসর সিতাভরা সিনহা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা স্ব স্ব বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা এবং করোনা-পরিস্থিতির বৈশ্বিক ও উপমহাদেশীয় প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করছিলেন।

বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণীয় ছিল প্রণয় রায় উপস্থাপিত প্রফেসর সিনহা উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের পুনর্সংক্রমণ সম্পর্কিত ‘আর-ফ্যাক্টর তত্ত্ব’। প্রফেসর সিনহা ভারতে খুব পরিচিত একজন ফিজিসিইস্ট, কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্ট ও ম্যাথামেথিশিয়ান। তিনি ভারতের ইনস্টিটিউট অব ম্যাথামেথিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর। ভারতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর যে লকডাউন প্রয়োগ করা হয় তার প্রভাব নিয়ে তিনি এই ইনস্টিটিউটের সহকর্মীদের নিয়ে গবেষণা করেন। এই গবেষণার ফল তারা একটি তত্ত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এতে তারা লকডাউন প্রয়োগ করার ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু কীভাবে সীমিত পর্যায়ে থেকেছে তা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি প্রিডিক্টরে দেখিয়েছেন লকডাউন করায় সংক্রমণ ও মৃত্যু কোথায় আছে আর লকডাউন না-হলে তা কোথায় যেতো।

একজন লোক সংক্রমিত হওয়ার পর তার থেকে কী হারে পুনর্সংক্রমণ হচ্ছে, এটা জানা এই তত্ত্বের মূল কথা। ‘রেইট অব রি-ইনফেকশন’ হলো আর-ফ্যাক্টর। যদি আর-ফ্যাক্টর ১-এর নিচে হয় অর্থ্যাৎ একজন লোক একের চেয়ে কম লোককে সংক্রমিত করেন তাহলে আস্তে আস্তে সংক্রমণ কমে আসবে। আর যদি বেশি হয় তাহলে সংক্রমণ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকবে। এই বাড়া ও কমার ক্ষেত্রে লকডাউন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি সারণিতে তারা ভারতের আর-ফ্যাক্টরের সঙ্গে বৈশ্বিক ও যুক্তরাষ্ট্রের আর-ফ্যাক্টরের তুলনা করেছেন। দেখা যাচ্ছে লকডাউেনর শুরুতে ভারতের আর-ফ্যাক্টর বৈশ্বিক ও যুক্তরাষ্ট্রের আর-ফ্যাক্টর থেকে ভালো ছিল। কিন্তু লকডাউন কার্যকর করার পর বর্তমান অবস্থায় ভারতের চেয়ে বিশ্বের ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ভালো। একই অবস্থা দাঁড়াবে লকডাউনের সামগ্রিক শতকরা হারেও। তখনও সারা বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্র ভারত থেকে এগিয়ে থাকবে।

দেখা যায়, ভারত ‘সম্পূর্ণ’ লকডাউন করায় ৯ মে পর্যন্ত ৩৯০০০ মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। যদি লকডাউন অব্যাহত থাকে তাহলে ১৭ মে পর্যন্ত এই সংক্রমণ ৬০০০০-এ পৌঁছাবে। যদি লকডাউন না-থাকতো তাহলে তা ২৫ লাখে পৌঁছাতো। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তাই। লকডাউন থাকায় ৯ মে পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৯০০ জনের। লকডাউন থাকলে ১৭ মে পর্যন্ত তা ২৯০০-এ পৌঁছাবে। যদি লকডাউন না-থাকতো তাহলে তা ১.২০ লাখে পৌঁছাতো। 

কোনো মহামারির উৎপত্তি স্থলের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের এতো প্রত্যক্ষ সংযোগ আগে কখনো ঘটেনি, যেটি ঘটেছে করোনাভাইরাসের জন্ম-শহর উহানের সঙ্গে। উহান শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের ৫ শতাধিক ছাত্র পড়াশোনা করেন। এদের অনেকে আতংকিত হয়ে দেশে যোগাযোগ করেন। ততদিনে উহানে ভাইরাসে ৪১ জন লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এক পর্যায়ে সরকার বিশেষ বিমান পাঠিয়ে তাদের আনার সিদ্ধান্ত নেয়। ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ৩১২ জন ছাত্র উহান থেকে দেশে ফিরে আসেন। এদের সবাইকে ১৪ দিন কোয়ারিন্টাইনে রাখা হয়। এরপর আরও ২৩ জন ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের সহায়তায় দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরা ঢাকায় আসার আগে দিল্লিতে ১৪ দিন কোয়ারিন্টাইনে ছিলেন। কড়াকড়িভাবে লকডাউন প্রয়োগ হওয়ায় তখন আমাদের ছাত্রদের কেউ সংক্রমিত হননি। এজন্য চীনা কর্তৃপক্ষের ধন্যবাদ প্রাপ্য। 

আমরা দেখেছি, আশংকা থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের সৌভাগ্য, উহান থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেনি। সংক্রমণ ঘটেছে মার্চে, ইউরোপ থেকে প্রবাসীরা দেশে আসার পর। ভাইরাস উহান থেকে ইউরোপ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের কারণে এর বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্ষমতায় কী পরিবর্তন ঘটেছে বা আদৌ ঘটেছে কিনা, ভাইরাসের বহুমাত্রিক পরিবর্তন-ক্ষমতার কথা সুবিদিত, তা রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে জানা যাবে। আমরা জানি, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য যেটি গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, উহান থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে সংক্রমণ না-ঘটায় বাংলাদেশ মহামূল্যবান এক সময় পায়। এই সময় কতটুকু সাফল্যজনকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে এই এক মাসে বাংলাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক যে প্রস্তুতি ঘটেছে সেটির গুরুত্বও কম নয়।

বাংলাদেশ ও ভারতে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ, বিস্তার, প্রথম মৃত্যু, লকডাউন প্রয়োগ ও লকডাউন প্রত্যাহারের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে। আমরা যখন লকডাউনের সঙ্গে উপরে উল্লিখিত আর-ফ্যাক্টরের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলছি তখন এসব বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার। যেমন বাংলাদেশে প্রথম কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন ৮ই মার্চ, ভারতে ৩০শে জানুয়ারি। ভারতে কোনো কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ঘটে ১০ মার্চ, বাংলাদেশে ১৮ মার্চ। ৯ মে পর্যন্ত ভারতে প্রায় ২ হাজার এবং বাংলাদেশে ২ শ’র বেশি লোক মৃত্যুবরণ করেছেন। ভারত লকডাউন প্রয়োগ করে ২০ মার্চ এবং বাংলাদেশ ২৬ মার্চ থেকে। 

বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশে প্রধানমন্ত্রীগণ কেন্দ্রীয়ভাবে সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা এবং তা প্রয়োগে দেশবাসীর মধ্যে এক ধরনের জাগরণ তৈরি করতে সক্ষম হন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ তাদের মতো করে লকডাউনের মাত্রা, ধরন, টেস্টিং, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্ব স্ব চিন্তা ও কর্মকৌশল প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছে। এসব থেকে সামগ্রিকভাবে ভারত সুবিধা ও অসুবিধা দুই-ই পেয়েছে। দিল্লিতে প্রথম দিকে সংক্রমণ বেশি হতে থাকায় কেজরিওয়াল সরকার এক সময় দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ‘টেস্টিং টেস্টিং ও টেস্টিং নীতি’ প্রয়োগের চেষ্টা করে। পরে তারা লকডাউন ও টেস্টিং এই নীতি প্রয়োগ করেন। ভারতের কিছু প্রদেশ যেমন কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ দক্ষতা দেখায়। কিছু প্রদেশের প্রান্তিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সংযোগহীনতা বা ন্যুনতম আন্তর্জাতিক সংযোগ তাদের সহায়তা করে। ভারতের ‘ক্লাস্টার কন্টেইনমেন্ট স্ট্র্যাটেজি’ও তাদের উপকারে আসে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রয়াস ও শক্তি নিয়ে ভারত যে মাত্রায় লকডাউন প্রয়োগ করেছে, বাংলাদেশ সেই মাত্রায় পারেনি। 

এমতাবস্থায় প্রফেসর সিনহার আর-ফ্যাক্টর প্রয়োগ করে আমরা দেখতে পারি বাংলাদেশের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।  ভারত আর-ফ্যাক্টর ১.৮৩ দিয়ে শুরু করে ১.২৭-এ নেমে এসেছে। সারা বিশ্ব ২.৭৫ দিয়ে শুরু করে ১.১২ এবং যুক্তরাষ্ট্র ২.৪৭ দিয়ে শুরু করে ১.২১-এ নেমেছে। বাংলাদেশ শুরুতে কোথায় ছিল, লকডাউন শেষে কোথায় পৌঁছাবে? আমরা জানি না। বাংলাদেশের জন্য প্রফেসর সিনহার আর-ফ্যাক্টর তত্ত্বের প্রধান প্রাসঙ্গিকতা হলো লকডাউন প্রত্যাহারের পূর্বে এ-রকম একটি প্রজেকশন উপস্থাপন করা। পরিস্থিতি ভালো দেখা গেলে খুবই ভালো। নেতিবাচক হলেও জাতির কাছে জানা থাকবে আমরা কোন স্তরে পৌঁছাচ্ছি। কোন দিকে যাচ্ছি।

কেউ কেউ বলেন, পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইতালির চেয়ে বেশি লোক বাংলাদেশে মারা যাবে না। সুতরাং অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে না-ফেলে লকডাউন প্রত্যাহারের দিকে যাওয়াই উচিত। তবে এ-ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রধান, বলা যায়, প্রায় একমাত্র অস্ত্র হলো লকডাউন। সেরা অস্ত্র প্রয়োগে টাইমিং ও মাত্রা সঠিক না-হলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এতো পরিশ্রম, এতো আত্নদান ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হবে। আর পলিসি প্রণয়নের সময় মাত্রার চেয়ে গুণের ওপর জোর দেয়া ভালো নীতি নির্ধারণী প্রশ্নের বিষয়। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা যাবে, প্রাণ ফিরে আসবে না, একটি হলেও। যে পরিবারের যাবে, তাদের কাছে একটি প্রাণ লাখো প্রাণের সমান।

লেখক: গবেষক ও লেখক


বিষয় : জালাল ফিরোজ চতুরঙ্গৱ

মন্তব্য করুন