আমাদের ওষুধ শিল্প নিয়ে গর্ব করার মত অনেক কিছুই রয়েছে, বিশেষ করে বিরাশির ওষুধ নীতির সুফল হিসাবে বহুজাতিক ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে হারিয়ে আমরা দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারকদের যে স্ফীতি গত কয়েক দশকে দেখেছি তা অভাবনীয়। উপযুক্ত মানের অষুধ প্রস্তুত করে আমরা দেশের চাহিদা পূরণের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছি সুনামের সাথে। সেই দেশে ওষুধ প্রস্তুতকারকরা বিশ্ব থেকে কোন ক্রমেই পিছিয়ে থাকার কথা নয়, তাই ওষুধ প্রস্তুতের খবরে পরমানন্দিত। এই প্রস্তুতির সাথে যারা যুক্ত তাদের অভিনন্দন। তবে কোন রোগ সংক্রামণ নিয়ে যখন বিপুল জনগেষ্ঠি আতঙ্কিত থাকে তখন সঠিক তথ্য ও নিয়ন্ত্রণ না থাকলে চরম বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

নতুন ওষুধ আবিষ্কার করা সহজসাধ্য কোন কাজ নয়। অতি আধুনিক কালে বিজ্ঞানের বিভিন্ন উচ্চতর শাখা যেমন কোষীয় ও আনবিক জীববিদ্যা, রাসায়নিক জীববিদ্যা ও অনুজীববিদ্যার উৎসেচক ভিত্তিক আণবিক সংশ্লেষণ, রিকম্বিন্যান্ট বায়োমলিকল ও স্টেম সেল গবেষণা- এ ধরণের আবিস্কারকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করলেও অষুধ আবিষ্কারে সময় কমাতে বা ব্যয় হ্রাসে তেমন উন্নতি ঘটাতে পারে নি। ভ্যাক্সিন (ভাইরাল সংক্রামন রোধে সুস্থ মানুষের দেহে প্রয়োগ করা হয়) ও এন্টিভাইরাল (ইতোমধ্যেই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত মানুষের রোগ নিরাময়ে প্রয়োগ করা হয়) অষুধ আবিস্কারের চারটি স্তর পেরিয়েই পঞ্চম স্তর অর্থাৎ ব্যবহারের অনুমোদন পর্যায়ে পৌছে। প্রথম স্তরে প্রতি ১০০ সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন বা এন্টিভাইরাল অষুধের মধ্যে মাত্র ১টি পঞ্চম স্তরে পৌছে, সময় নেয় ২ থেকে ১৮ বছর ও ২০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়।

চতুর্থ স্তরে এ ভাবে উপস্থাপিত ওষুধকে ‘ইন্ধসঢ়;ভেস্টিগেশন্যাল নিউ ড্রাগ’ বা আইএনডি বা পরীক্ষাধীন ওষুধ বলা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব একত্রিত হয়ে কভিড ১৯ এর অষুধ আবিষ্কারের যে যুদ্ধে নেমেছে তাতে অনেক বিশেষজ্ঞই আশা করছেন যে ছয় থেকে আঠারো মাসেই সফলতা আসতে পারে।

মোডার্না ইনকের এমআরএনএ-১২৭৩ রয়েছে তৃতীয় স্তরের প্রথম ধাপে, অস্ট্রেলিয়ার সিএসআইআরও -এর ভ্যাকসিন রয়েছে দ্বিতীয় স্তরে, টনিক্স ফার্মাসিউটিক্যাল হোল্ডিং কর্পোরেশনের ভ্যাকসিন রয়েছে দ্বিতীয় স্তরে ইত্যাদি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নায় রেমডেসেভির তৃতীয় স্তরের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে লেরোনলিমাব তৃতীয় স্তরের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। জাপানের ফ্যাভিপিরাভির তৃতীয় স্তরের তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে কলভ্যালসেন্ট প্লাজমা এক্সপেরিমেন্টাল হিসাবে মৃতপ্রায় কোভিড ১৯ রোগীর দেহে প্রয়োগের অনুমোদন পেয়েছে।

ভাইরাসের অতি দ্রুত অভিযোজন ক্ষমতা অর্জনের গুন আছে, যার মাধ্যমে ভাইরাস সদ্য আবিস্কৃত ওষুধ প্রতিরোধের সক্ষমতা ঘটায়। এ কারনে যথোপযুক্ত স্তরসমূহ পার না করে তড়িঘড়ি এ ধরণের পরীক্ষাধীন অষুধের সার্বজনীন ব্যবহার ‘ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ ঘটিয়ে ‘সুপার বাগ’ সৃষ্টি করতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগেই বিশ্বের এ বিষয়ের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা ভাইরাস ব্যক্টেরিয়াসহ বিভিন্ন জীবাণুর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অষুধের অসঙ্গত ব্যবহার যে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি করবে তা ভবিষৎবাণী করেছিলেন, তাই বর্তমান দূর্যোগ বিজ্ঞানের চোখে আকস্মিক কিছু নয়।

উন্নত বিশ্বে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ইন্ধসঢ়;ভেস্টিগেসন্যাল ওষুধসহ এন্টিবায়োটিক, এন্টিভাইরাল ইত্যাদি ওষুধ ক্রয় করা যায় না। আমাদের দেশে আমরা সবাই মুড়ি-মুড়কির মত যখন ইচ্ছা যত ইচ্ছা তত ওষুধ কিনে ফেলতে পারি- শুধু টাকা থাকলেই হলো। উপসর্গ নিরাময়ে অথবা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধকে কখনও কোন রোগের ওষুধ বলা হয় না। সেকারনে এখন পর্যস্ত কোভিড ১৯ রোগের ভ্যাক্সিন বা এন্টিভাইরাল ওষুধ নেই। কোনভাবেই কোভিড ১৯ এর ওষুধ বলে কোন কিছুকেই উপস্থাপনের কোন সুযোগ নেই।

কোন রোগের নিরাময়ে কোন ওষুধ না থাকলে বিদ্যমান অষুধ থেকে অতি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্বাবধানে মহা বিপর্যস্ত রোগীকে সারিয়ে তোলার চেষ্টার রেয়াজ বহু কাল থেকেই স্বীকৃত। রোগীর রোগ নিরাময়ে এ ধরনের কোন কোন ওষুধ প্রথমে খুব কম সংখ্যক রোগীর উপর প্রয়োগ করা হয়। এ এক্ষেত্রেও কার্যকারীতা প্রমানে বিপুল সংখ্যক রোগীর উপর ‘ডবল ব্লাইন্ড রানডোমাইজইড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ বাধ্যতামুলক। এধরনের পরীক্ষায় ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে যার ফলাফল জানতে অন্তত এক মাস অপেক্ষা করতে হবে।

ওষুধের যথোচ্ছা প্রয়োগে মানব দেহের ব্যাপক ক্ষতিসহ চলমান দূর্যোগের মত বিশ্ব বিপর্যয় রোধেই অষুধ আবিস্কার, প্রস্তুত, বিপনন, বিক্রয় ও ব্যবহারের উপর এত বিধি-নিষেধ। বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় গত কয়েক বছর ধরে চলমান ঔষধ প্রশাসনের নিরলস প্রচেষ্টার পরও ওষুধ প্রস্তুত, বিপনন, বিক্রয় ও ব্যবহার এমন কি আবিষ্কারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। সে কারণে নতুন করোনা আবির্ভাবের সাথে সাথেই একজন চানাচুর বিক্রেতার স্বপ্নে পাওয়া করোনার ওষুধসহ ইউনানী-আয়ুরবেদী ওষুধের আবির্ভাব আমরা দেখেছি। জনসাধারণ যখন সানিটাইজার, ডিসইনফেক্ট্যান্ট, কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মতই বাজার থেকে এন্টিম্যালেরিয়াল ওষুধ কেনার হিড়িক ফেলে দিতে সফল হয় তখন ওষুধ বিক্রয়ের নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের অসাহয়ত্বের প্রমান মেলে। উপরে আলোচিত ওষুধগুলো কোনক্রমেই করোনার ব্যাপক বিস্তার রোধে কোন প্রভাব ফেলবে না বলেই এখন পর্যন্ত প্রমাণিত। ইতোমধ্যেই পরীক্ষাগারে ইঁদুরের উপর ফ্যাভিপিরাভির প্রয়োগে টেরাটোজেনিক ইফেক্ট (কোন ওষুধ সেবনের কারণে গর্ভবতী মায়েরা যে বাচ্চা প্রসব করেন তার বিভিন্ন অঙ্গবিকৃতি ঘটার ক্ষমতা) প্রমাণিত হয়েছে। এসব বিবেচনায় সরকারের ওষধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ‘লক ডাউনের’ মতই করোনার জন্য ওষুধ বিক্রয়ে আইনের প্রয়োগে কঠোর অবস্থানে যাওয়া অতি জরুরি।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়