- চতুরঙ্গ
- সোমেন চন্দ: শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি
সোমেন চন্দ: শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

চল্লিশের দশক অখণ্ড বঙ্গের রাজনীতি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি-প্রগতি ও গণতান্ত্রিক চেতনার চর্চায় এক উত্তাল সময়। একই সময়ে বিপরীত ধারার প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উপস্থিতিও লক্ষ করা যায় প্রবলভাবে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের' সময়কালও এটা।
তৎকালীন বিশ্বে সব পরাশক্তি এবং বেশির ভাগ রাষ্ট্রই এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী শুরু হয় ধ্বংসলীলার মহাতাণ্ডব। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসি শক্তিসমূহ তাদের আধিপত্য বিস্ত্মারে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে এবং জন্ম দিতে থাকে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার। সৃষ্টি করে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত রক্তস্নাত রাজনৈতিক বিভাজনের। ধর্ম, রাজনীতি ও শ্রেণিস্বার্থ- সবকিছুই মানবতার মুখে কালি লেপন করতে থাকে। সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মহাতাণ্ডবের মধ্যে ঢাকার মাটিতে জন্ম নেয় সোমেন চন্দ (জন্ম : ২৪ মে ১৯২০, মৃত্যু : ৮ মার্চ ১৯৪২)।
সোমেন চন্দ একাধারে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের অগ্রসেনানি, পাশাপাশি প্রগতিশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতিজগতেরও পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সোমেন চন্দের জীবনকাল মাত্র ২২ বছর। এই ২২ বছর সময়কালে তিনি নিজেকে একাধারে একজন কথাসাহিত্যিক ও মার্কসবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানবিকতাবোধে বিশ্বাসী আরো অনেককেই আমরা স্মরণ করতে পারি, যাঁরা এই বাংলার মাটিতে মনুষ্যত্ববোধের তাড়নায় মানবতাবিরোধীদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ন্যায়নীতিতে অবিচল সোমেন দর্শন ও সাহিত্যকে যেভাবে একই সুতায় গেঁথেছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
১৯৩৭ সালের দিকে সোমেন যখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, তখন তাঁর পরিবার বসবাস করত ঢাকার দক্ষিণ মৈশুণ্ডিতে। এ সময় তিনি আন্দামান ফেরত কমিউনিস্ট বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশীর সান্নিধ্যে আসেন এবং ঢাকার কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। ক্রমান্বয়ে প্রগতি পাঠাগারসহ বিশ্বরাজনীতি-অর্থনীতি, মার্কসবাদ, কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ইত্যাদি-সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি সংগঠনে নেতৃত্ব দিতে থাকেন।
সোভিয়েত বিপ্লবের বিজয়ের পর প্রগতি সাহিত্যচর্চায় বিশ্বব্যাপী এক জাগরণ সৃষ্টি হয়। নতুন যুগের ভোরে বিশ্ববাসী জেগে উঠতে শুরু করে। নতুন নতুন শিল্প-সাহিত্য, কবিতা গান নৃত্য নাটক চলচ্চিত্র চিত্রকলা ভাস্কর্য সৃষ্টি হতে থাকে এক নতুন আবেগে। যার প্রতিফলন ঘটে আমাদের সমাজে-সাহিত্যে, মননে-দর্শনে এবং জীবনবোধে ও শিল্পচর্চায়। চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষে একে একে গড়ে ওঠে ইয়ুথ কালচারাল ইনস্টিটিউটস, সোভিয়েত সুূদ সমিতি, প্রগতি লেখক সংঘ, ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত 'বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ'-এর ঢাকা শাখা আনুষ্ঠানিক যাত্রা করে ১৯৩৯ সালে। ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রগতি লেখক সংঘ ঢাকা শাখার প্রথম সাধারণ সম্পাদক রণেশ দাশগুপ্তের ভাষ্যমতে- প্রগতি লেখক সংঘের ঢাকা শাখার গোড়াপত্তনে প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন সোমেন চন্দ। সোমেন যুক্ত ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নের কাজের পাশাপাশি লেখক সংঘের সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক বৈঠকগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন এবং তার ওপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পালন করতেন।
১৯৪১ সালের দিকে যখন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম তুঙ্গে, সে সময় ঢাকার বহু কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীকে ধরে জেলখানায় বন্দি করা হয়। এই অস্থির সময়েই সোমেন যুক্ত হন 'ঢাকা রেলওয়ে মজুর-ইউনিয়নে'র সঙ্গে এবং মাত্র ২১ বছর বয়সে ঢাকার 'ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে'র সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার পরও শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি প্রগতি লেখক সংঘের কাজ এগিয়ে চলে সমান গতিতে। একদিকে যেমন মজুরের বস্ত্মিতে, কারখানার গেটে ইঞ্জিন শেডের কাছে কয়লার ধোঁয়ার নিচে দাঁড়িয়ে শোষিত কর্মক্লান্ত মজুরদের সঙ্গে তাঁর কথা হতে থাকে, তেমনিভাবে প্রগতি লেখক সংঘের নিয়মিত বৈঠকগুলোতে উপস্থিত হওয়াসহ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখা এবং লেখাও চলতে থাকে সমানতালে। তাঁর সাহিত্যের মধ্যে থাকে শ্রমিক জীবনের অভিজ্ঞতা। সোমেন চন্দ প্রকৃতপক্ষে একজন জীবনশিল্পী। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন, শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা না থাকলে প্রগতি সাহিত্য রচনা করা যায় না। তিনি আরো বুঝতে পেরেছিলেন যে যুগের পালাবদলে প্রোলেটারিয়েটের ভূমিকাই প্রধান। তাদের মধ্যে যদি কাজ করা না যায়, তাহলে শৌখিন কমিউনিস্ট হয়ে লাভ কী? আর তাই রাজনৈতিক কাজ, ট্রেড ইউনিয়নের কাজ এবং পড়াশুনা ও লেখা একসাথেই চালিয়ে গেছেন।
সোমেন চন্দ আপাদমস্তক মার্কসবাদী চিন্ত্মায় বিশ্বাসী একজন বিপতবী। একইভাবে গল্প-সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবেও নিজেকে মেলে ধরেছেন। কৈশোর পেরোনোর আগেই সোমেন মার্কসবাদী রাজনীতি ও মার্কসীয় সাহিত্যে অনুরাগী হয়ে ওঠেন এবং এই মার্কসবাদই তাকে মানুষের প্রতি অনুরক্ত করে তোলে, যা তাকে সাহিত্যের গভীরতায় প্রবেশ করে জীবনবোধে সমৃদ্ধ করেছে। সোমেন আমাদের সামনে মানবতাবাদী মেহনতি মানুষের সংগ্রামী প্রত্যয়যুক্ত সাহিত্যের এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে গেছেন। মাত্র ২২ বছরের জীবন, যার শেষ চার-পাঁচ বছর মাত্র সাহিত্য রচনার সুযোগ পেয়েছেন সোমেন। এই স্বল্প সময়ে তিনি লিখেছেন প্রায় ২৮টি গল্প, বন্যা নামে একটি উপন্যাস, বিপতব ও প্রস্ত্মাবনা নামে দুটি একাঙ্কিকা ও তিনটি গদ্য কবিতা। সোমেন যেসব গল্প লিখেছেন তার বিষয়, ব্যাপ্তি, শিল্প, ভাষাশৈলী অবাক করার মতো। সোমেন তার লেখার মধ্য দিয়ে নতুন যুগের কথা, উৎপীড়িতের জাগরণ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের কাহিনি তুলে ধরেছেন, যা শ্রেণিচেতনার এক নিরেট দলিল হয়ে উঠেছে। একইভাবে সেখানে স্থান পেয়েছে নানা ধরনের উপমা-ব্যঞ্জনা। তাঁর লেখায় নৈসর্গিকতা স্থান পেয়েছে এমনভাবে, যা প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে তুলেছে মেলবন্ধন। ফলে তা পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। এক কথায় বলা চলে, সোমেন তাঁর গল্পে দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা প্রকাশে পরিবেশের বর্ণনা ও সংলাপের সুচিন্তিত প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি শিল্পীর সঙ্গে শিল্পের যে মমত্ব থাকা দরকার, সেটাকেও ফুটিয়ে তুলেছেন অনুপম মাধুরীতে। সোমেন তাঁর গল্পসমূহে মানবজীবন ও কালের প্রবহমানতার যে সম্পর্ক রচনা করেছেন, তা তিনি প্রগতি সাহিত্যের দরবারে রাতের গভীরতা অতিক্রম করে তেজোদীপ্ত সূর্যের আগমনবার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
আমরা লক্ষ করেছি, সোমেনের জীবন মাত্র বাইশ বছরের। এই বাইশ বছরেই তিনি নিজেকে রাজনৈতিক কর্মী ও সাহিত্যকর্মী হিসেবে জনমানসে গভীর আকর কেটেছেন। দুই ভিন্ন সত্তার অবস্থান সজীব রেখে খুন হয়ে যাওয়া এক স্বপ্নদর্শী তরুণ সোমেন চন্দ, যিনি তাঁর তারুণ্যে জীবনের মানে খুঁজতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম, বুকের গভীরে এঁকেছিলেন স্পন্দিত শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জন্য এক মুক্ত সমাজ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নির্মাণের স্বপ্ন। তাই তিনি তাঁর অধিকাংশ গল্পে মানুষকেই উলটে-পালটে উপস্থাপন করেছেন। উপস্থাপন করেছেন মানুষের ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রতিদিনের ঘাত-প্রতিঘাত, যাপিত জীবনের বৈশিষ্ট্যসমূহ। আর তা তিনি সংগ্রহ করেছেন চারপাশের সংগ্রামী মানুষের জীবন থেকে, বিশেতষণ করেছেন নিজস্ব দার্শনিক চিন্তার গভীরতায়। যে কারণে তা পরিণত হয়েছে মানবমুক্তির ইশারায়। অথচ মানুষরূপী একদল দানব মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আঘাতের পর আঘাত করে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়, পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি বের করে আনে।
এক পৈশাচিক অট্টহাসিতে মেতে ওঠে তারা। নিভে যায় বিকাশোন্মুখ প্রতিভাধর রাজনৈতিক, ছোটোগল্পকার, সাহিত্যিকের জীবনপ্রদীপ। তবে তারা কেড়ে নিতে পারেনি মুষ্টিবদ্ধ হাতের মুঠোয় ধরে থাকা রক্ত পতাকা, কেড়ে নিতে পারেনি মনের গভীরে লালিত রক্ত শপথ। জন্মশতবর্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
সহ-সাধারণ সম্পাদক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ
মন্তব্য করুন