- চতুরঙ্গ
- করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিক না মনুষ্যসৃষ্ট?
করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিক না মনুষ্যসৃষ্ট?

এটা অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে করোনা কি মানুষের তৈরি নাকি প্রাকৃতিক নিয়মেই এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ এক গবেষণায় এ ব্যাপারে খুব যুক্তিগ্রাহ্য কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।
একটা আন্তর্জাতিক গবেষণা টিম জীনগত পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাপারটা উৎঘাটন করেছে। গবেষণাটি বিখ্যাত জার্নাল 'ন্যাচার মেডিসিন' প্রকাশ করেছে গত ১৭ মার্চ। সেখানে, ক্রিস্টিয়ান এন্ডারসন (স্ক্রিপস গবেষণা ইনস্টিটিউট, ক্যালিফোর্নিয়া), রবার্ট গেরি (তুলানে ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন, নিউ অরেলিনস) এবং তাদের সহকর্মীরা মিলে অত্যাধুনিক বায়ো-ইনফরমেটিক্সের কৌশল ব্যবহার করে বেশ ক'টি করোনা ভাইরাসের জীনগত ডাটা পরীক্ষা করেছেন।
গবেষকগণ প্রথমে করোনার স্পাইক প্রোটিনের জীনগত বৈশিষ্ট্য উৎঘাটন করার চেষ্টা করেন। সমস্ত করানো ভাইরাস, স্পাইক প্রোটিনের উপরই নির্ভর করে অন্য কোষকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে প্রতিটি করোনা ভাইরাস তাদের এই স্পাইক প্রোটিন পরিবর্তন করেছে। বিবর্তনের নিদর্শন হিসেবে তাদের জীনে এই পরিবর্তনের ধরা স্পষ্ট ভাবে খোদাই করা আছে।
নতুন করোনার স্পাইক প্রোটিনে কিছু বিশেষ ধরনের অভিযোজন ঘটেছে। উল্লোখযোগ্য একটা অভিযোজন ফলে এরা মানুষের কোষের এঙ্গিওটেনসিন কনভারর্টিং এনজাইম বা 'এসিইটু' রিসেপ্টর প্রোটিনের সাথে যুক্ত হতে পারে। এসিইটু প্রোটিনটি মানুষের শ্বাসনালী এবং ফুসফুসে থাকে। এ ছাড়াও আমাদের রক্তনালীতেও এই প্রোটিনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রচলিত কম্পিউটার মডেলিংয়ের মাধ্যমে ধারণা করা গেছে যে, কভিড-১৯ ভাইরাসটি মানুষের কোষের এসিইটু প্রোটিনের সাথে যুক্ত হতে পারে না। কিন্তু, বাস্তবে এই নতুন করোনা ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন, এসিইটু প্রোটিনের সাথে খুব শক্ত ভাবে যুক্ত হতে পারে যা কম্পিউটার ভাবতেও পারেনি। তার কারণ, সম্ভবত নতুন করোনাটি বিবর্তনের মাধ্যমে কিছু পরিবর্তিত হয়েছে। এর মাধ্যমে সে এসিইটু এর সাথে বিকল্প সংযুক্তির স্থানে যুক্ত হতে পারে যেটা আগে অনাবিষ্কৃতই ছিল। প্রকৃতির কত বিচিত্র, চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো একবার!
নিশ্চয়ই এখন আরও জানতে ইচ্ছে করছে কিভাবে এই পরিবর্তন গুলো হয় এবং কিভাবেই বা বিজ্ঞানীরা সেটা আবিষ্কার করেন। বাংলাদেশেও এসব বিষয়ে এখন বিশ্বমানের কাজ শুরু হায়েছে। পাঠক, চাইল্ড হেল্থ রিসার্চ ফাউন্ডেশন ড. সামীর সাহা এবং ড. সেঁজুতি সাহার করোনার জিনম সিকোয়েন্স এর ব্যাপারে নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। এছারা, সাভারের ন্যাশনাল ইন্সিটিউট অব বায়োটেকনোলজিও দাবি করেছেন তারা ইতোমধ্যেই এই প্রকারের করোনার জিনম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেছেন এবং আরও কিছু ভিন্ন ধরনের করোনার জিনম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের গবেষণাগুলি বাংলাদেশের মানুষকে আরও বিজ্ঞান মনস্ক করে তুলবে বলে আমি আশাবাদি। যাই হোক, এই সব নতুন তথ্য থেকেই বিজ্ঞানীরা দৃঢ় ভাবে নিশ্চিত যে, কেউ ল্যাবে বসে মানুষকে আক্রান্ত করার জন্য নতুন করোনাটি বানায়নি। বানালে, তারা এখন পর্যন্ত জানা ছিল না এমন কোনো স্পাইক প্রোটিন তৈরি করত না যেটা কিনা মানুষের এসিইটু রিসেপ্টত প্রোটিনের উপর কাজ করবে না যেহেতু, এতদিন পর্যন্ত এসিইটু বিকল্প সংযুক্তির স্থানটি আজানাই ছিল।
পরবর্তী সময়ে, নতুন করোনা ভাইরাসের শুধু স্পাইক না সারা দেহের জীনের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণে নামলেন গবেষকেরা। তাদের ডাটা এটা প্রমাণ করে যে নতুন করোনা ভাইরাসটির সারা দেহের জীনের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল রয়েছে বাদুড়ের করোনা ভাইরাসের। কিন্তু, যে অংশটি মানুষের এসিইটু প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হয় সেটার সাথে মিল রয়েছে পাঙ্গলিনসের (আমরা যেটাকে বনরুই বলে চিনি) দেহের করোনা ভাইরাসের সাথে। এটা, আবারও প্রমাণ করে করোনা ভাইরাস যেটা মানুষের কোভিড-১৯ অসুখের জন্য দায়ী তা প্রকৃতি থেকেই এসেছে। যদি, এই নতুন করোনা ভাইরাসটি ল্যাবে তৈরি করা হতো তাহলে বিজ্ঞানীরা সেই ধরনের করোনা গুলোকেই বেছে নিত যেগুলো ইতোমধ্যেই জানা আছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর সে গুলোর কোনো একটিকে।
তাহলে, কোন প্রাকৃতিক উৎস থেকে নতুন করোনা ভাইরাসটি এসেছে, যেটা কিনা কভিড-১৯ এর কারণ? গবেষকদের কাছে এখনও সুনিদৃষ্ট উত্তর নেই; তবে তাদের দুটো ধারণা রয়েছে।
প্রথম ধারণাটি হচ্ছে, যেহেতু নতুন করোনাটি বাদুর বা বনরুই এর দেহ থেকে এসেছে, হয়তো সেখানেই এর মিউটেশনের মাধ্যমে মানুষের এসিইটু প্রোটিনের সাথে যুক্ত হবার ক্ষমতা অর্জন করেছে যার ফলে সেটা মানুষকে আক্রান্ত করতে পেরেছে। এই ধারণাটা সম্প্রতি কালের সার্স, যেটা কিছুটা বিড়ালের মত দেখতে সিভেটস নামক একটা প্রাণী থেকে উদ্ভূত; আবার মার্স, যেটা উট থেকে উদ্ভূত সেগুলোর সাথে উৎপত্তির দিক থেকে মিল আছে।
দ্বিতীয় ধারণাটি হচ্ছে, মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জনের অনেক আগেই এই নতুন করোনাটি প্রাণীর দেহ থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে থাকতে পারে। পরবর্তীতে, বিবর্তনের ধারায় হয়তো কয়েক বছরে অথবা কয়েক দশক ধরে পরিবর্তিত হয়ে মানুষকে আক্রান্ত করার এমনকি মেরে ফেলার মতো ক্ষমতা অর্জন করেছে এই নতুন করোনা।
এই দুটো ধারণার যেটাই সত্য হোক না কেনো, এটা অন্ততঃ পরিষ্কার হয়েছে প্রকৃতি থেকেই উৎপত্তি হয়েছে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী এই নতুন করোনার। আর এটা শাপে বরই হয়েছে, কারণ এতে করে আমরা অন্তত কিছু বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারবো যেগুলো সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, এবং সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মী এবং গবেষক যাঁরা নিরলস পরিশ্রম করছেন এই দুর্যোগ থেকে মানবকূলকে উদ্ধারের জন্য তাঁদেরকে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগানো।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
vc-sur@artsci.kyushu-u.ac.jp
মন্তব্য করুন