- চতুরঙ্গ
- কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে হুঁশ ফিরবে না?
কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে হুঁশ ফিরবে না?

একুশ শতকের তৃতীয় দশক যেন আলোর মুখই দেখল না। নিকস কালো অন্ধকারে ঢেকে রইল তার মুখ। বছরের পাঁচ মাস শেষ গেল, করোনা থাবায় দুনিয়া থমকে দাঁড়িয়ে আছে। খুব শিগগির যে অবস্থার উন্নতি হবে তার আলামত দেখা যাচ্ছে না। বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বড় দুঃসময়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে, বিশ্ববাসীকে সতর্ক করছে। এরই মধ্যে চীনের শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট ’ব্যাট উইম্যান’ নামে পরিচিত শি ঝেং লি বলেছেন, কভিড-১৯ নাকি অতিমারির হিমশৈলীর চূড়ামাত্র। আসল বিপদ সামনে।
এই যখন অবস্থা, তখন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কভিড-১৯ অতিমারি একদিন থামবে; কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ন থামাতে না পারলে সে বিপদ হবে অনেক বেশি ভয়ংকর। বিপদে পড়বে গোটা মানব জাতির অস্তিত্বই।
করোনা ভাইরাস বা কভিড-১৯ সম্পর্কে আমরা শুনছি মাত্র কয়েক মাস। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদ সম্পর্কে গোটা বিশ্ব আলোড়িত অন্তত তিন দশক ধরে। কিন্তু এত বিজ্ঞান গবেষণা, এত এত দলিল দস্তাবেজ, এত এত আন্দোলন কোন কিছুই বিশ্বের মোড়লদের কাছে পাত্তাই পায় নি। অদূর ভবিষ্যতে পাবে তেমন কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র তো অনেক ঝুটঝামেলা শেষে ওবামা আমলে এসে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সই করেছিল। কিন্তু তার উত্তরসূরী ট্রাম্প বাহাদুর গদিতে বসেই সে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেন। বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্পর্কে আন্দোলনকারীরা যা বলেন, ট্রাম্প সাহেব তা ’হোক্স’ বা ’ফুঁকোবাজি’ বলে উড়িয়ে দেন। এটা ট্রাম্প চরিত্রের সাথে বেশ মানানসই বটে।
কিন্তু অন্য দেশের কী ভূমিকা? চীন এখন দুনিয়ার কারখানা। চীনের কারাখানা বন্ধ তো দুনিয়ার চাকা ঘোরা থেমে যায়। সেই চীন বিশ্ব উষ্ণায়নকে থোড়াই কেয়ার করে। অথচ চীন এখন দুনিয়ায় উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাসের চার ভাগেরর এক ভাগ তৈরি করে। একক ক্লোরো-ফ্লোরো-কার্বন উৎপাদনে শীর্ষে চীনের অবস্থান। নিজেকে চীন উন্নত দেশ বলেও স্বীকার করতে চায় না। তাদের মতে, গত শতকে চীন ছিল তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে থাকা দেশে। বিপ্লবের পর গত ৭০ বছরে সে উন্নয়নশীল দেশের খাতায় নাম লিখিয়েছে মাত্র। ইউরোপ আমেরিকার মত উন্নত ও বিত্তশালী হতে তার এখনো ঢের বাকি। কাজেই বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধ চুক্তিতে সাই দেবার সময় এখনো তার হয় নি। ওসব চুক্তি সই করুক ইউরোপের উন্নত, ধনী দেশগুলো আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাফ কথা চীনের।
ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা চীনের এসব কথায় নিজেদের বেশ নিরাপদ ভাবে। মতাদর্শে বা কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক অথবা সামরিক সম্পর্ক চীনের সাথে যার যা-ই হোক না কেন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে এসব দেশ বেশ চীনের ছাতা ব্যবহারে উৎসাহী এবং করেও খুব দক্ষতার সাথে।
আর বাংলাদেশের মত গরিব দেশগুলো? অনুন্নত দেশগুলো? তাদের অবস্থানও বেশ মজার। বাংলাদেশ, মালদ্বীপের মত দেশ যারা এখনই পানির নিচে তলিয়ে যায় যায় অবস্থায় তারা এখন অ্যাডাবটেশন ফান্ড বা টিকে থাকার তহবিল পেতে মরিয়া। বিষয়টি যদি সেখানেই থামত, তাহলে অবশ্য কথা ছিল না। তাদের ঘাঁড়ে এক নতুন দৈত্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। উন্নত দুনিয়ার বাতিল করা প্রযুক্তি এনে বসানোর দৈত্য। সারা দুনিয়ায় কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতির বর্জ্যে তারা নাস্তানাবুদ। সেগুলো কিনে এনে বসাচ্ছে বাংলাদেশের মত কিছু গরিব দেশ। তাদের অনেক বিদ্যুৎ দরকার। কেননা, তাদেরও স্বপ্ন দ্রুত উন্নত, ধনী দেশে রূপান্তরিত হওয়া।
বাংলাদেশে তেমন দুটো বিষবৃক্ষ পায়রা ও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীদের আবেদন নিবেদন, আন্দোলনের তোয়ক্কা না করে বিশে^র সবচেয়ে পরিবেশ ঝুঁকির দেশের একটি বাংলাদেশে পায়রা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এখানে উৎপাদিত হবে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ এগিয়ে চলেছে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রয়েছে চীন এবং রামপালে ভারত। এই দুই দেশে রয়েছে বিপুল কয়লার মজুদ। তারা তা আমাদের কাছে গচিয়ে দিয়ে লাভবান হতে চ্য়া। রামপালে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগিয়ে চলেছে এই প্লান্ট ভারতে স্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থ হয় পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখে। কিন্তু সেটাই রামপালে চালান করে দেয় ভারত। এই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়েক হাজার চীনা ও ভারতীয় কাজ করে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবযেয়ে ঘনবসতির দেশগুলোর অন্যতম। আর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় একের পর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। তাতে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বলি হয়। ক্ষতি হয় লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ। ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা এবং মাত্র কয়েকদিন আগে (২০ মে, ২০২০) আম্পান ভারত ও বাংলাদেশে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এসব ঝড়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় সুন্দরবন। কিন্তু মুনাফাখোরদের কাছে সুন্দরবন কেবল এক বন, লুটপাটের খনি। তারা যেকোন ভাবে এই বন ধ্বংস করতে চায়।
দুনিয়াজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকেই পরিবেশের প্রশ্নটি গুরুত্বসহকারে আলোচিত হচ্ছে। মাত্র গত বছর আমাজন বন পুড়ে ছাই হয়েছে। তখনই বিবেকবান মানুষের বুকে হাহাকার ওঠে। তারা আশংকা প্রকাশ করে যে, দুনিয়াজুড়ে ধেয়ে আসতে পারে কোন অজানা প্রাকৃৃতিক দুর্যোগ। গত পাঁচ মাস স্থবির হয়ে আছে পৃথিবী। তেলের দাম কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। ৭০ ডলারের তেলের ব্যারেল এখন বিকোচ্ছে মাত্র ২০ ডলারে! চাকাবন্ধ পৃথিবীর আকাশমণ্ডলে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় উন্নতি হচ্ছে পরিবেশের। স্যাটেলাইট ছবি আমাদের এসব জানাচ্ছে। কিন্তু কত দিন?
করোনা এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি মানুষ। নিরন্তর গবেষণা চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে নতুন পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজার দখলের ঘোড়দৌঁড়। গত পাঁচ মাসের লোকসান পুষিয়ে নিতে তারা নতুন করে ছক কষছে।
বিশ্বব্যাপী যেখানে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে নতুন উদ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের রহস্য কোথায়? শক্তি উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার যন্ত্রযুগের শুরু থেকে। সেটা আঠারো শতকের কথা। কয়লার খনি এবং বাষ্পীয় ইঞ্জিন ইউরোপকে আধুনিক বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল।
দুশ' বছরের বেশি সে দাপট দেখেছে মানুষ। কিন্তু খনিজ তেল ও গ্যাসের ব্যবহার শেখার সাথে সাথে কয়লার ব্যবহার কমতে শুরু করে নানা কারণে। খনি থেকে কয়লা তোলা, ভিন্ন কোন স্থানে নিয়ে যাওয়া, তা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সকল পর্যায়ে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ করে কয়লা ও কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প। তাই দুনিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে উন্নত দেশগুলো। বিপরীতে ঘটছে অন্য ঘটনাও। যেমন যাদের হাতে এখনও বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ আছে তারা তা বেঁচে দু'পয়সা কামিয়ে নিতে চায়। আবার যাদের পুরনো কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো পড়ে আছে কাঁধের বোঝা আর বর্জ্য হয়ে তারাও চায় কোথাও এগুলো গচাতে পারলে দুটো পয়সা যেমন আসে, তেমনি এই আবর্জনার স্তূপের ভাগাড় হিসেবে ক্রেতা দেশগুলোকে ব্যবহার করা যায়।
এসব হিসেব নিকেশ করে উন্নত দেশগুলো এসব অচল প্লান্ট, প্রযুক্তি বিক্রির ধান্ধায় থাকে। আর আমাদের মত গরিব দেশকে সে ফাঁদে আটকে ফেলে মারে। কিন্তু যে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি সারা দুনিয়া তাতেও কি মানুষের হুঁশ ফিরবে না? বাংলাদেশ কি ভেবে দেখবে না এসব সর্বনাশা প্রকল্প লাভের চেয়ে কত বেশি ক্ষতি করবে দেশের?
লেখক: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
amirulkhan5252@gmail.com
মন্তব্য করুন