- চতুরঙ্গ
- করোনাকালের একমাত্র ওষুধ সহমর্মিতা
করোনাকালের একমাত্র ওষুধ সহমর্মিতা

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারির প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে কতগুলো দৃশ্য, ঘটনা, ব্যাবস্থা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আপনাকে যদি চোখ বন্ধ করে ভাবতে বলা হয় আপনি কোন কোন বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছেন বা তা চিন্তা করতে বলা হয় তাহলে আপনার মাথায় কোন কোন বিষয়গুলো আসতে পারে? প্রতিটা মানুষের চিন্তার জায়গা, বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা আলাদা ধরে নেওয়ার পরেও কি কিছু কিছু বিষয় মিলে যেতে পারে? আমাকে একই প্রশ্ন করলে আমার মাথায় যে বিষয়গুলো আপাতত আসছে তা বলে ফেলি, দেখুন মিলে যায় কিনা।
প্রথমত, রাষ্ট্র ও সরকারের জনস্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপণায় দুর্বলতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের বা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নৈরাজ্য। আমরা দেখতে পাই শুরু থেকেই সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি ছিলো, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত আইসোলেশন কেবিন বা বেড নেই, টেষ্ট করতে গিয়ে মানুষজনের বিড়ম্বনা, বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি না করানো এবং পরবর্তীতে ভর্তি করানোর পরে ভুতুরে বিল ধরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত, খেটে খাওয়া মানুষদের জীবিকার যোগান নিশ্চিত না করে রাস্তাঘাটে তাদের বের হতে নিষেধ করা এবং পরবর্তীতে জীবিকার তাগিদে তারা বের হওয়ার পরে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং উচ্চপদস্থ কর্তাব্যাক্তি দ্বারা নির্যাতিত ও লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা।
তৃতীয়ত, ত্রাণ বিতরণে জনপ্রতিনিধিদের অনিয়ম ও দুর্নীতি। আমরা দেখেছি কিভাবে সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দ ত্রাণ সামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায় তাদেরই জনপ্রতিণিধিদের বাড়িতে বা গুদামে।
চতুর্থত, মানুষের নিজের প্রয়োজনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। আমরা দেখেছি কিভাবে ব্যাবসায়ীরা করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যর দাম বৃদ্ধি করেছে, এমনকি কভিড-১৯ এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাস্ক, সেনিটাইজারের মত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের দামও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া। আবার অবস্থাসম্পন্ন মানুষরা তাদের প্রয়োজনেরও অধিক পণ্য ক্রয় করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছে।
পঞ্চমত, করোনা সংক্রমিত রোগী এবং তার পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, এমনকি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীর লাশ দাফনে বাধা দেওয়া। করোনা হাসপাতাল পর্যন্ত উত্তরা এবং তেজগাঁওতে করতে দেওয়া হয়নি।
ষষ্ঠত, লকডাউন শিথিল করার উদ্যোগের মধ্যে পরিবহন ভাড়া ষাট শতাংশ বৃদ্ধি করা।
উপর্যুক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে বিষয়টা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণভাবে ধরা পড়েছে তাহলো, সহমর্মিতার অভাব। উপরের প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রচুর সহানুভূতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আমার চোখে পড়েছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সামষ্টিকভাবে সহমর্মিতা চোখে পড়েনি। এটা সত্য যে, করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। এই মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর দুর্বলতা। কিন্তু আমার মতে এই মহামারি যে বিষয়টি আমাদের সামনে একেবারে উদোম করে দিয়েছে তাহলো, মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার অভাব। ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে না উঠতে পারার অক্ষমতা, নিজের কর্মকাণ্ড কিভাবে অন্যদের প্রভাবিত করছে সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা না করতে পারার বৈকল্য এবং সর্বোপরি নিজেকে সমাজের প্রান্তিক মানুষজনের জায়গায় দেখতে পারার দরুণ তাদের সমস্যাগুলোকে নিজের সমস্যা হিসেবে দেখতে না পারার ব্যার্থতা।
সহমর্মিতাকে করুণার সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবেনা। কারণ দুটি ভিন্ন অনুভূতি। করুণা বা সহানুভূতি হলো আরেকজনের জন্য দুঃখবোধ করা, এটা সাময়িক অনুভূতি। যেমন, আপনি রাস্তায় কাউকে পড়ে থাকতে দেখলেন এবং নিজের মধ্যে একটা দুঃখবোধ করলেন যে, আহাওে বেচারা! আপনার ভীষণ খারাপ লেগেছে। তারপর আপনি আপনার প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং সেই পড়ে থাকা ব্যাক্তি নিয়ে আমার দুঃখবোধও ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে বা আপনি ভুলে গেছেন। কিন্তু সহমর্মিতা এর থেকে ভিন্ন। আপনি যখন অপরের দুর্ভাগ্য বা দুর্দশার জায়গায় নিজেকে দেখতে পান তা আপনার মনে যে অনুভূতির জন্ম দেয় তাহলো সহমর্মিতা। যখন আপনি ওই ব্যক্তির জায়গায় আপনাকে দেখবেন রাস্তার সেই জায়গায় এমন নিথর বা বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকতে, আপনি কি তখনো চলে যেতে পারবেন? সম্ভবত না। আপনি ওই ব্যাক্তির কাছে যাবেন, বোঝার চেষ্টা করবেন কি হয়েছে, তাকে কিভাবে সাহায্য করা যায় আপনি তা ভাবতে শুরু করবেন। মোদ্দা কথা, আপনি তাকে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে আসতে পারবেন না। আপনি নিজের জন্য যা যা করতেন চেষ্টা করতেন সেই ব্যক্তির জন্যও তাই করার, কারণ সেই ব্যাক্তির মধ্যে আপনি আপনাকে দেখতে পেয়েছেন।
করোনা পরিস্থিতিতে এই সহমর্মিতা আমরা রাষ্ট্র থেকে সমাজে কোথাও খুব একটা দেখতে পাইনি। অথচ একটা মহামারী আমাদেরকে যে শিক্ষা দেয় তা হলো একাকী বেঁচে থাকা যায়না, সমাজের এক অংশ বাদ দিয়ে অন্য অংশের টিকে থাকা দুরুহ। মহামারি আমাদের বলে যায়, একা শুধুমাত্র নিজের জন্য বেঁচোনা, এটা অর্থহীন। এ বিষয়টা সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝার জন্য প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত আলব্যায়ার কামু’র বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা প্লেগ’।
কামুর উপন্যাস আলজেরীয়ার উপকূলবর্তী একটা শহরে রহস্যজনক প্লেগ মহামারি হানা দেওয়ার গল্প বলে। তিনি প্লেগকে তুলনা করেন যন্ত্রণা ভোগের একটা ব্যাখ্যাহীন প্রপঞ্চ হিসেবে, কারণ প্লেগ কেন পৃথিবীতে আসলো তার কোন ব্যাখ্যা নেই, কেউ চাক বা না চাক এটা পৃথিবীতে ছিলো এবং সামনে চলে এসেছে। কামুর উপন্যাস আমাদেরকে প্রশ্ন করে, মহামারির এই দিশাহীন অবস্থায় আমরা কি তাহলে আমাদের যন্ত্রণাগুলোকে ব্যক্তিকভাবে ভোগ না করে সামগ্রিকভাবে ভাগাভাগি করে ভোগ করতে পারি না? এবং এটা করার মাধ্যমে মহামারীর সময়কে ইতিবাচক পরিবর্র্তনে কাজে লাগাতে পারি না?
উপন্যাসের মূল চরিত্র ডাক্তার রিউজ শুরু থেকেই প্লেগকে প্রতিরোধ করা এবং সংক্রমিতদের সাথে একাত্মতা ও সংহতি অর্জনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়। তার মনের ইচ্ছা পরিচালিত হয় সংক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ত্যাগকে সামনে রেখে। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই সংজ্ঞায়িত হয়েছে এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে। কেউই এর থেকে বাঁচতে পারেনা কিন্তু যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেছে এবং অন্যদের যন্ত্রণা ও দুর্দশা লাঘব করতে সচেষ্ট হয়েছে তারাই শেষতক নিজেদেরকে সম্পূর্ণ ও সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। উপন্যাসের একমাত্র ভিলেন তারাই যারা নিজেদের বাইরে গিয়ে এই মহামারিকে দেখতে পায়নি, শুধুমাত্র নিজেদের নিয়েই ব্যাস্ত ছিলো। এইসব মানুষের জন্য প্লেগ ছিলো হয় পালিয়ে বেঁচে থাকার কিংবা মানুষকে আরো শোষণ করার একটা সুযোগ মাত্র। তাদের ব্যক্তিস্বার্থের চেয়েও ভয়ানক ছিলো তাদের নিজেদের স্বার্থ আসলে কোন বিষয়গুলোকে চাপা দিয়ে দেয়, সেগুলো হলো, জটিল মিথষ্ক্রিয়ার উপর ভর করা সমাজের যূথবদ্ধ অবস্থা এবং সংহতির নৈতিকতা, যেগুলো সমাজ ও সম্প্রদায় গঠনের অন্যতম স্তম্ভ।
বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাই যে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যার্থ হয়েছে সহমর্মিতার জায়গা থেকে করোনা মোকাবেলা করতে। সাধারণ মানুষ যাদের বলা হচ্ছে তারাও পারেনি তাদের প্রয়োজন আর নিরাপত্তার বাইরে গিয়ে অন্যদের কথা ভাবতে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এবং মুক্তবাজার অর্থণীতির এই যুগে কেউই নিজেদের ক্ষতি মেনে নিতে পারছেনা, ফলে চেষ্টা করছে শোষনের মধ্যে দিয়ে তাদের মুনাফা নিশ্চিত করতে কিংবা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। ফলাফল, মহামারির দরুণ নাজুক অবস্থায় থাকা মানুষের আরো বেশি অনিশ্চয়তা ও দুর্দশার দিকে ঠেলে দেওয়া।
কামু তার উপন্যাসের শেষে লিখেছিলো, প্লেগ শেষ নয়। মহামারির বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম কখনোই শেষ হবেনা। করোনাভাইরাস তার সেই ভবিষ্যৎবাণী প্রমাণ করলো। কিন্তু আমরা তার উপন্যাসের মর্ম ও শিক্ষা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছি আবারো। তার উপন্যাসের থেকে যে উপলব্ধি আমরা পাই তাহলো, সম্প্রদায় হিসেবে মানুষের টিকে থাকার শক্তি, মহামারির প্রস্তুতি মানে শুধু নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবা নয় বরং নিজের কর্মকাণ্ডের কারণে অন্যরা কোন ঝুঁকিতে পড়লো কিনা তা ভেবে কাজ করা। সংক্ষেপে সমাজের এবং সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়ে ভাবা, তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। আমরা কি সে চেষ্টা এখনো করে দেখতে পারি না?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন