গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হবার পর থেকে এর সংক্রমণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনার আক্রমণে আমরা সবাই চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছি।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ দৃশ্যমান হলেও এটা স্পষ্ট যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দোদুল্যমানতা সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও ডেকে এনেছে। আমরাও বুঝে বা না বুঝে, আবেগের বশে সামাজিক যোগাযোগসহ অন্যান্য মাধ্যমে নিজের ক্ষোভ ও আক্ষেপ প্রকাশ করছি যা কাম্য নয়। মনে রাখা দরকার, করোনা মোকাবেলায় যারা সম্মুখে কাজ করছেন তাদের অনুভূতিতে আঘাত না হেনে বরং যতটা সম্ভব তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা উচিত। আরো মনে রাখতে হবে, করোনা যুদ্ধে আর্থিকভাবে অবদান রেখে অথবা সম্মুখে কাজ করেই শুধু অবদান রাখা যায় তা নয়। নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করেও আমরা এর অংশীদার হতে পারি।

মুক্তিযুদ্ধ যারা সামনে থেকে দেখেছে এবং সেই দুঃসহ স্মৃতিকে মনে রেখেছে এমন মানুষগুলো এখন প্রবীণ এবং তাদের সংখ্যাও কমে আসছে। বলতে গেলে, দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের সিংহভাগই ইতোপূর্বে এমন কোন বড় বিপদের সম্মুখীন হয়নি। বিষয়টি যেমন আমাদের সাধারণ জনগণের ক্ষেত্রে একটি কঠিন সত্য তেমন আমাদের প্রশাসন ও নীতি নির্ধারকদের কাছেও। তাই করোনা মহামারীর এই আকস্মিক আক্রমণ নিঃসন্দেহে প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষকে কিছুটা হলেও বিপর্যস্ত করেছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। 

রাষ্ট্রের এই সংকটকালে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সরকার মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার মাধ্যমে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মহীন ৫০ লাখ পরিবারের প্রতিটিকে এককালীন আড়াই হাজার করে মোট ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার নগদ সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কিন্ত এর তালিকা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও জালিয়াতির আভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া, ৩ কোটি ৮৫ হাজার কর্মহীন নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষকে সরকারের বিশেষ ত্রান সহায়তা দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদেরকে তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হলেও এমপি ও স্থানীয় সরকার প্র্রতিনিধিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে এখনও তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। এর আগে সরকার ১০ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ওএমএস-এর চাল দেবার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, চরমভাবে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হওয়া ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের লাগামহীন চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে তা কিছুদিন পর স্থগিত করা হয়। 

পরবর্তীতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারগুলোর ত্রাণ বা রেশনের চাহিদা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে কার্যক্রম পুনরায় চালু করেছে। সরকার উপলব্ধি করেছে যে, এই কার্যক্রমে স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে সফল হওয়া কঠিন। কারণ, সর্বস্তরের জনগণের কাছে রাষ্ট্রীয় সেবাসমূহ সঠিকভাবে পৌছানোর জন্য সরকারের কাছে এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকারের চেয়ে বিস্তৃত কোন নেটওয়ার্ক নেই। শুধুমাত্র স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে তাদেরকে স্থানীয় পর্যায়ের কার্যক্রম থেকে বাদ না দিয়ে বরং নিবিড়ভাবে দুর্নীতিবিরোধি নজরদারিতে রেখে, স্থানীয় সরকারের শক্তিকে ব্যবহার করতে হবে। 

স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রণয়নের কাজটি বেশ জটিল। এক্ষেত্রে দলীয় ব্যক্তিবর্গকে সরাসরি দায়িত্ব অর্পণ না করে প্রতিটি এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিরপেক্ষ অপিনিয়ন লিডার যেমন- শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী নেতা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতা, সমাজ কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ সুশীল সমাজের সদস্যদের সম্পৃক্ত করে খসড়া তালিকা তৈরি করতে পারে। পরবর্তীতে প্রশাসন যাচাই করে তা চূড়ান্ত করতে পারে। একাজে প্রশাসন স্থানীয় স্কুল কলেজের শিক্ষকদেরকে কাজে লাগাতে পারে। সরকার প্রয়োজনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জরুরি ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে 'কমিউনিটি পুলিশ বাহিনী' গঠন করতে পারে অথবা আনসার বাহিনীর ক্ষমতা কিছুটা বৃদ্ধি করে তাদেরকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সমান্তরালে কাজ করার সুযোগ দিতে পারে।

ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী এখনো দেশের ১৪ শতাংশ মানুষ খাদ্য সংকটে রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারসহ উল্যেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠান বৃহৎ পরিসরে অবদান রাখলেও দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে নিজস্ব উদ্যোগে যে পরিমাণ আর্থিক সহায়তা ও ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তার পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন হলেও নেহায়েত কম নয়। এই বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপগুলোকে সমন্বিত করে একটি বিশেষ পদক্ষেপের আওতায় আনলে, নিঃসন্দেহে ক্ষুদ্র অথচ মহান পদক্ষেপগুলো অনেক বেশি ফলপ্রসূ হত। তাছাড়া, সেনাবাহিনী বিশেষ উদ্যোগে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে প্রক্রিয়ায় ত্রাণ পৌছে দিচ্ছে, যদি এরকম আরো কিছু সহজ প্রক্রিয়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিশ্চিত হত, যেখানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকত তাহলে মন্দ হত না। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও দৈনন্দিন কাজের বিভিন্ন অ্যাপস-এ প্রবেশ করলেই, 'বিদ্যানন্দ'সহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্থার দেখা মেলে, যেখানে চাইলেই যে কেউ দান করতে পারে। সরকার চাইলে তার উন্মুক্ত তহবিলগুলোকে এভাবে জনসম্মুখে আনতে পারে। এ ব্যাপারে সকল গণমাধ্যমে নানান আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিতে পারে। এতে নিঃসন্দেহে সর্বস্তরের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনগণের অনুপাত প্রতি ৮০০ জনে ১ জন। একইরকম অবস্থা চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও। প্রতি ২৫০০ জনে মাত্র ১ জন চিকিৎসক আছেন। তাই লকডাউন ঘোষণা করলেই যে তা কার্যকর হবে বা জনগণ অসুস্থ হলেই যে চিকিৎসা পাবে, এমন নয়। এরকম বিলাসিতা দেখানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। চিকিৎসা ক্ষেত্রে সরকার নতুন করে দুই হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ হাজারের অধিক নার্সকে নিয়োগ দিয়েছে, এবং আরো দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের কথা ভাবছে। এরকমভাবে আরো চিকিৎসক ও নার্সকে অস্থায়ী ও খণ্ডকালীন দায়িত্ব প্রদান করলে চিকিৎসাখাতকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সম্ভব হবে।

আসলে, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর এধরনের আপদকালে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিতে হয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার যে কাজটি ব্যাপকভাবে করতে পারে তাহলো সর্বস্তরের জনগণের অংশীদারিত্ব তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা। ব্যক্তিপর্যায়ে কোন একজন গবেষক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক বা যে কেউ করোনা মোকাবেলায় কার্যকর একটি ওষুধ, উপাদান বা অন্য কোন কৌশলের সন্ধান পেলে উদ্ভাবনকারীকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করাসহ বিশেষভাবে মূল্যায়ন উচিত। কারণ, ব্যক্তি পর্যায়ের যেকোনো উদ্ভাবন এই দুর্দিনে জনজীবনকে কিছুটা হলেও সহজ করবে। 

এই বৈশ্বিক মহামারি থেকে পরিত্রাণের উপায় হতে পারে আমাদের সমষ্টিগত সচেতনতা। সরকার আর্থিক ক্ষতির তোয়াক্কা না করে বারবার লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়েছে এবং সম্প্রতি গ্রিন, ইয়োলো ও রেড জোন ভাগ করে এলাকাভিত্তিক লকডাউনের কৌশল গ্রহণ করেছে। অথচ শুধুমাত্র সমষ্টিগত সচেতনতার অভাবে বারবার আমরা লকডাউনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এর উদ্দেশ্যকে নষ্ট করছি, যা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এজন্য সকলের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন যাতে দেশের প্রতিটি নাগরিকের এই উপলব্ধি হয় যে, করোনাকলের কঠিন পরিস্থিতিতে আর কেউ নয় কেবল ব্যক্তি নিজেই দায়বদ্ধ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়