ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ৭৫ বছর বয়সে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে ইন্তেকাল করলেন। তার মৃত্যুতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।

সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন-  'দুর্নীতি করবো না, দুর্নীতি হতেও দেব না।' মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ২০১৯ সালে শতভাগ  সুষ্ঠু ও সফল হজ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। তিনি দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'আমি হাজীদের চোখের পানি দেখতে চাই না। যাদের কারণে হাজীদের চোখে পানি ঝরবে তাদের চোখের পানি আমি ঝরিয়ে ছাড়বো।' তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাজকীয় সৌদি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হজযাত্রীর কোটা বৃদ্ধি, সৌদি আরবেব হাজীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং হজযাত্রীদের সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দরের পরিবর্তে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রি-অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়েছে।

শেখ মো. আব্দুল্লাহ ছিলেন আলেম-ওলামাবান্ধব নিবেদিতপ্রাণ একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও খাঁটি দেশপ্রেমিক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ধারণ করে তিনি ইসলাম ও আলেম-ওলামাদের কল্যাণে নিরলস কাজ করে গেছেন। তিনি আলিয়া-কওমি, পীর-মাশায়েখ সব ধরনের আলেম-ওলামার সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কওমি আলেমগণের দীর্ঘদিনের দাবি দাওয়ারে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান তথা কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি প্রদানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে সারাদেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ স্থাপন প্রকল্প গ্রহণেও তিনি ভূমিকা পালন করেন। তিনি বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের মূল ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপনে উদ্যোক্তাও ছিলেন। এছাড়া মহিলা মুসল্লীদের নির্বিঘ্নে ইবাদতের সুবিধার্থে বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের মহিলা নামাজকক্ষে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সংযোজন করেন। ৬ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষাধিক উলামা-মাশায়েখের সমাবেশে হারামাইন শরীফাইনের ইমাম ও খতিবের মেহমান হিসেবে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া দেশের শীর্ষস্থানীয় ৫৮ জন আলেমকে রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসেবে হজে প্রেরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যে কোনো ধর্মীয় ইস্যুতে তিনি আলেম-ওলামাদের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামার সাথে পরামর্শ করতেন।

বিরাজমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মরহুম শেখ মো. আব্দুল্লাহর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সকল মসজিদ ও কওমি মাদ্রাসার অনুকূলে আর্থিক অনুদান প্রদান এবং বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান প্রকল্প মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের সানুগ্রহ অনুমোদন প্রদান করেন। এছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে মসজিদ ব্যবস্থাপনা ও জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তার আগ্রহে দু'দফায় শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ বৈঠকে মিলিত হন। আলেম-ওলামার সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে করোনাকালে মসজিদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্দেশ জারি করেন। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক আলেম-ওলামাকে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়।

শেখ মো. আব্দুল্লাহ ১৯৪৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার মধুমতী নদীর তীরবর্তী কেকানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মতিউর রহমান ও মা রাবেয়া খাতুনের চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। স্থানীয় গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় পবিত্র কুরআন হিফযের মাধ্যমে তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন। তিনি সুলতানশাহী কেকানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং সুলতানশাহী কেকানিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৬১ সালে মেট্রিক পাস করেন। তিনি খুলনার আযম খান কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৬৬ সালে বিকম (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে এমকম এবং ১৯৭৪ সালে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল ল' কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

শিক্ষাজীবন শেষে শেখ মো. আব্দুল্লাহ সুলতানশাহী কেকানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অ্যাডভোকেট হিসেবে গোপালগঞ্জ জজকোর্ট এবং ঢাকা জজকোর্টে  আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি চাকরির পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং নেতৃত্বে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

শেখ মো. আব্দুল্লাহ খুলনার আযম খান কমার্স কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে আওয়ামী যুবলীগে যোগদান করেন। গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনে শেখ মো. আব্দুল্লাহ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যাপক অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট মুজিব বাহিনীর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ ঘাতকের বুলেটের আঘাতে শাহাদাত বরণ করলে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগকে সংগঠিত ও সুসংহত রাখতে আপসহীন ভূমিকা পালন করেন।

এক-এগারোতে শেখ হাসিনা যখন কারারুদ্ধ হন তখন তার মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ আব্দুল্লাহ। তিনি আজীবন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ও জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত, অনুগত ও আস্থাশীল ছিলেন।

শেখ আব্দুল্লাহর মৃত্যুতে দেশের আলেম-ওলামাসহ ধর্মপ্রাণ জনসাধারণ হারালো একজন আলেম-ওলামাবান্ধব মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ হারালো একজন দেশপ্রেমিক জননেতা। আমরা বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।


লেখক: পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন