- চতুরঙ্গ
- এখনই সময় হাওরে বেড়ানোর
এখনই সময় হাওরে বেড়ানোর

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
হাওর অঞ্চলে বেড়ানোর জন্য বর্ষাকালই উপযুক্ত সময়। দ্বীপের মত করে গড়ে ওঠা ঘরবাড়িগুলো বর্ষাকালে যেমন চোখজুড়ানো দৃশ্যপট তৈরি করে, তেমনি শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হাওরাঞ্চলে পাখ-পাখালিদের কলতান কিংবা শুষ্ক মৌসুমের পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদের ছড়াছড়ি হাওরকে এক শিল্পীর হাতের সুনিপুণ চিত্রপটের রূপ দেয়। বর্ষায় হাওরের দখিনা বাতাস যখন পালতোলা নৌকাগুলোকে শন শন শব্দে উড়িয়ে নিয়ে চলে এবং সেই সাথে বিস্তীর্ণ জলরাশির ছন্দের তালে তালে ভেসে যাওয়া প্রকৃতিতে যোগ করে সরলতার নতুন মাত্রা। রাতের হাওর এলাকায় ডিঙি নৌকাগুলোর ভরপানিতে কুপিবাতি জ্বালিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য কিংবা চাঁদের আলোয় আলোকিত চঞ্চল ঢেউগুলোর চিকমিক করা হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য যেকারো স্মৃতিপটে দাগ কাটবে। আর এই মোহনীয় প্রকৃতির রূপ বৃদ্ধি পায় শ্রাবণের দমকা বাতাসের সাথে গর্জে উঠা জলরাশির মেলবন্ধনে।
হাওরের সুপ্রাচীন জাগরণ আমাদের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ, সৃষ্টি করেছে হাছন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের মত সঙ্গীতজ্ঞ, যা একঅংশ হিসেবে যুক্ত হয়েছে হাওর অঞ্চলের মহিমা বৃদ্ধিতে। সবুজের সমারোহে ভরপুর ও হলুদ সর্ষে ফুলের দৃশ্যে পরিপূর্ণ হাওরের ধুঁ ধুঁ মাঠ শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হয় এক নয়নাভিরাম ও নৈস্বর্গিক লীলাভূমিতে।
বাংলাদেশের জেলাসমূহের মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সর্বোচ্চ ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জ জেলায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এই হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল অঞ্চলে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে যার সুবিধা আমরা এখনো উপভোগ করতে পারিনি।
মূলত আমাদের দেশে হাওর পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এর শুরু কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। দেশীয় কিছু তরুণ পর্যটক নিজ উদ্যোগ হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নৌকা নিয়ে হাওরের বুকে ভেসে বেড়াত। তার পর আস্তে আস্তে এর ব্যাপকতা লাভ করতে শুরু করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হাওর অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য তেমন কোনো অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা গড়ে উঠেনি। এর ফলে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া, নিরাপত্তাসহ অন্যান্য আরও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমানে দু’একটি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর সিলেট অঞ্চলে হাওর ভিত্তিক ট্যুর প্যাকেজ চালু করেছে।
আমাদের পাশের দেশ ভারত তাদের এই উন্মুক্ত জলাশয়ে পর্যটনের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। মূলত ভারতের কেরালায় এর প্রচলন খুব বেশি দেখা যায়। সেখানে জলাশয়ের বুকে ভেসে ভেসে একজন পর্যটক প্রকৃতি ও চারপাশের মানুষের জীবন অবলোকন করতে পারে। আর তার জন্য বিশেষ ধরনের জলজান ব্যবহার করা হয়, যাতে পাঁচ তারকা মানের হোটেলের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থাকে। পাশাপাশি পর্যটকের জন্য স্থানীয় শিল্প সংস্কৃতি উপভোগ করার ব্যবস্থা থাকে। এতে প্রচুর সংখ্যক বিদেশি পর্যটক প্রতিবছর কেরালা ভ্রমণ করে থাকে। আমাদের দেশেও এই রকম সুযোগ সুবিধা তৈরি করা গেলে হাওর-কেন্দ্রিক পর্যটনে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে।
হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় যেমনি ডুব দিতে পারেন, তেমনি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পেতে সাঁতার কাটতে পারেন নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে। সংস্কৃতি প্রেমীদের কাছে রাতের চাঁদের আলোর নিচে নৌকায় বসে স্বাদ নিতে পারেন বাউল ও মরমী কবি সাধকদের গানগুলোর সুর তুলে কিংবা হাওরের শীতল হাওয়া ও পূর্ণিমার আলোয় রাত্রিযাপন করে। বর্ষাকালে হাওরের কোল ঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝর্না, হাওর-বাওরের হিজল, করচ, নলখাগরা বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানান প্রজাতির বনজ, জলজ প্রাণী আর হাওর পাড়ের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌর্ন্দযে মুগ্ধ হওয়ার মত খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। আর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পাখির মিলন মেলা ও সবুজের সমারোহ শীতের মৌসুমে গড়ে ওঠা চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যে মন প্রাণ ছুঁয়ে যাবে পর্যটকদের।
বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হিসেবে পরিচিত সিলেট ও মৌলভীবাজারের ৫টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওর প্রায় ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত। হাকালুকি হাওরে শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমন ও স্থানীয় প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির কলতান মুখরিত পরিবেশ ভ্রমণপিয়াসুদের আহ্বানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০০০ সালে রামসার সাইটের তালিকায় স্থান করে নেওয়া সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ছোট বড় প্রায় ৩০টি ঝর্না ভারতের মেঘালয় থেকে এসে মিশেছে। সেই সাথে হাওড়জুড়ে ৪৬টির মত দ্বীপসদৃশ ছোট ছোট গ্রাম প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে।
১২০টি বিল ও ১৮০টি নিম্নাঞ্চল মিলে তৈরি হওয়ায় স্থানীয়ভাবে পরিচিত "নয়কুড়ি কাঁদার ছয়কুড়ি বিল" বলে খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বচ্ছ পানির সাথে ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপ এবং শীতকালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির বিচরণ এক অকল্পনীয় জীববৈচিত্র্য গড়ে তুলেছে। বাংলার কাশ্মীর হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুরের নীলাদ্রি লেক বা টেকেরঘাট পাথর কেয়ারী নামে পরিচিত এই স্থানটি ছোট বড় টিলা, নীল পানি ও পাহাড়কে সমন্বয় করে এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে।
ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার। এই জেলা হাওর-বাওরের জেলা নামে অধিক পরিচিত। এইখানে হাওরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। পানিতে দ্বীপের মত ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, স্বচ্ছ জলের খেলা, মাছ ধরতে জেলেদের ব্যস্ততা, ছোট ছোট জলাবন- এমন সব অভিজ্ঞতার খোরাক পেতে চাইলে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার নিকলী হাওরে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর বিকল্প নেই।
কিশোরগঞ্জের আরেকটি বিখ্যাত হাওর অঞ্চল হলো মিঠামইন হাওর। হাওরে নৌকা ভ্রমণের পাশাপাশি মালিকের দরগা ও দিল্লির আখড়ার মত জায়গায় ঘুরতে প্রতিনিয়ত পর্যটকদের সমাগম ঘটছে। কিশোরগঞ্জের পানিবেষ্টিত অষ্টগ্রাম উপজেলাটি অষ্টগ্রাম হাওরের মাঝে অবস্থিত, বর্ষাকালে দ্বীপের মত মাথা উঁচু করে থাকা গ্রামগুলো শীতকালে নতুনরূপ ধারণ করে। জেলে জীবন ও গ্রামীণ জীবনের স্বাদ পেতে প্রতিদিন পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছে অষ্টগ্রাম হাওরে। হাওরবেষ্টিত কিশোরগঞ্জ জেলার ব্যাপক উন্নয়নে সেখানে তৈরি হয়েছে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা। হাওর প্রধান ইটনা-মিঠামইন আর অষ্টগ্রাম উপজেলার উন্নয়নের মাধ্যমে সারা বছরব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে পর্যটকদের আনাগোনা।
বর্ষাকালে পানিতে আবদ্ধ হাওড়বাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে হাওড় এলাকায় পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধি করে নতুন নতুন পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত করে। শুধুমাত্র সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ৩ হাজার ৬৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বর্ষায় প্রায় সবটুকুই ডুবে যায়, এখানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে বর্ষায় ৭-৮ লাখ মানুষ অলস সময় কাটায়। জেলায় সে অর্থে বিকল্প কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে পর্যটন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
হাওর এলাকায় পর্যটন বিকাশ ঘটাতে সবচেয়ে যেটি বেশি প্রয়োজন, তা হলো জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি করে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে তুলে ধরা। পর্যটকদের স্বাভাবিক যোগাযোগ সুবিধা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। হাওরের পর্যটনকে তুলে ধরতে বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক মাধ্যমসমূহের ব্যবহার, পর্যটন সেবা প্রদানকারী সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়মিতভাবে আলোচনা, হাওর জেলাগুলোতে স্যানিটেশনের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা ও সেই সাথে পর্যটন টাওয়ার স্থাপন করে পর্যটকদের সেবার ব্যবস্থা করা, নিয়মিত বিরতিতে হাওর এলাকায় সচেতনতা বাড়াতে বার্ষিক উৎসবের আয়োজন করা ও সর্বোপরি হাওর অঞ্চলে পর্যটন সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন