- চতুরঙ্গ
- করোনা মহামারি কবে শেষ হবে?
করোনা মহামারি কবে শেষ হবে?

মহামারি সাধারণত কয়েকটি প্রকারে হ্রাস পায় এবং ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের মাধ্যমে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। আক্রান্তদের প্রকৃত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা ও মৃত্যুর হার কমানো এবং কার্যকরী ভ্যাকসিন বা টিকার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ।
অন্যদিকে যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী মহামারির একটি বিরাট অর্থনৈতিক প্রভাব আছে। কারণ, যে কোনো মহামারিতে একটি অর্থনৈতিক ধস নামে। সাধারণ জনগণের উদ্বেগ বাড়ে। মানুষ আতঙ্কিত হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং একই সাথে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। অন্যদিকে, অনাহার ও খাদ্যাভাবে অপুষ্টি ও নানাবিধ রোগ-ব্যাধির প্রকোপ বিস্তার লাভ করে। তখন অন্য কারণে মানুষের মৃত্যুহার বেড়ে যায়। এগুলো খুবই জটিল একটা সমীকরণ। অন্তত পেছনে তাকালে বা মহামারির রোগতত্ত্ব ইতিহাসগুলো বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হয়।
মনে রাখতে হবে, জনগণের মধ্যেঅসুস্থতার মহামারি ছাড়াও ভয়েরও একটি মহামারি ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে পারে। ভয়াবহ কালো মৃত্যুর ইতিহাস আমরা জানি। বুবোনিক প্লেগ বিশ্বকে কয়েকবার আঘাত করেছে, লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছে। তাই অতীত মহামারির স্মৃতিই আমাদেরকে নতুন আবির্ভূত মহামারিতে ভীত করে তোলে।
২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ১১ হাজারেরর বেশি মানুষ ইবোলায় মারা গিয়েছিল, অথচ বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই এর কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ ইবোলা বৈশ্বিকভাবে ছড়ায়নি। তেমনিভাবে সাম্প্রতিক দশকের অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি যেমন সার্স, মার্স, এবং ২০০৯ সালের এইচওয়না এনওয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, জিকা,এইচআইভি- এসব বেশিরভাগই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীতে বা দেশে সীমাবদ্ধ ছিল। অথবা প্রত্যাশিত ভয়াবহতার দিক থেকে ছিলো হালকা। বিপরীতে, ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বব্যাপী ৫০ কোটি বা ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, যা ছিল তখনকার বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ আর ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি বা ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত হংকং ফ্লুতে যুক্তরাষ্ট্রের ১ লাখ লোকসহ ১০ লক্ষ বা এক মিলিয়ন লোক বিশ্বব্যাপী মারা গিয়েছিলে। বেশিরভাগই ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ। ভাইরাসটি এখনও প্রতিবছর মৌসুমী ফ্লু হিসাবে আবির্ভূত হয়।
কোভিড-১৯ মহামারি প্রত্যেক রাষ্ট্রকে সরাসরি আক্রান্ত করছে, সবার দৈনন্দিন রীতি-নীতি ও সামাজিক জীবনের প্রকৃতি পরিবর্তন করে ফেলেছে। একইসাথে, এই বৈশ্বিক মহামারির জন্য দেখা দিবে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
তাই, কোভিড-১৯ কবে শেষ হবে বলা মুশকিল। সম্ভবত, করোনভাইরাস মহামারিটি সত্যিকার অর্থে শেষ হওয়ার আগেই সামাজিকভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি সাম্প্রতিক সময়ে জনগণের বাইরে বের হওয়ার প্রবণতায়। বিধি নিষেধের কারণে মানুষ ক্লান্ত আর হতাশার জন্য মানসিক ও অস্থিরতার এক ধরনের চাপের মধ্যে পড়ে যায়। যেটা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে ঘটছে।
এখন মারাত্মক পরিণতি এড়াতে চারটি জিনিস করা দরকার এবং খুবই দ্রুততার সাথে। প্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো- চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য দ্রুত মাস্ক, গ্লাভস এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করা। কারণ যদি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা সুস্থ থাকতে না পারেন, তবে সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, রোগ নির্ণয়ের সংকট নিরসন করে টেস্টিং, ট্র্যাকিং এবং ট্রেসিং নিশ্চিত করা। অর্থাৎ পরীক্ষার পরিধি আরও বিস্তৃতকরণের মাধ্যমে রোগী শনাক্তকরণ, তার সংস্পর্শের সকলকে চিহ্নিতকরণ ও অনুসরণ জরুরিভাবে করতে হবে।
তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে অভ্যস্ত হওয়া। চতুর্থত, চিকিৎসা ব্যবস্থা ত্বরান্বিত ও নিশ্চিতকরণ করতে হবে, যা অবশ্যই মানসম্পন্ন ও পর্যাপ্ত রোগী ধারণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। তবে কখনই তৃতীয় প্রয়োজনের ওপর নির্ভরতা কমালে চলবে না, অর্থাৎ ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করতেই হবে। ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পরা বন্ধ করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
সামাজিক ও শারীরিক দূরত্বের গুরুত্ব এখন অবশ্যই জনসাধারণকে মেনে নিতে হবে। সকলেরই দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে রক্ষা করার এবং একইসাথে অন্যদেরকেও রক্ষা করতে হবে। অতএব জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এ ব্যাপারে সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা সম্পর্কে জনগণকে প্রভাবিত ও প্রস্তুত করার দায়িত্ব সরকারসহ আমাদের সবার। খেয়াল রাখতে হবে- জনগণ যাতে কোনো ভুল বার্তা না পায়।
এখনও অবধি, এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার হয়নি। কয়েকটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় গিয়েছে। বিজ্ঞানীদের এটি একটি নিঃসন্দেহে বড় সাফল্য। যেমন এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং বের করা ছিলে আরেকটি সাফল্য। কারণ এছাড়া তো বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিছু করা সম্ভব না। সম্ভবত, নতুন এই করোনভাইরাসটি আরও বেশিদিন না হলেও কমপক্ষে আরো কয়েক বছরের জন্য আমাদের মাঝে থাকবে। বর্তমান নির্দেশিত স্বাস্থ্য ও সামাজিকবিধি- ব্যবস্থাগুলো পালন করতে পারলেই শুধুমাত্র আমরা নিশ্চিতভাবে স্বাভাবিকতার অবস্থায় জীবনযাপন করতে পারবো। স্কুলগুলো আবার খুলতে পারবে। স্বাভাবিক অবস্থা যেমন ধীরে ধীরে ফিরে আসবে তেমনি ভাইরাসটার সাথেও বিভিন্নভাবে আমাদেরকে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। তবে এর জন্যে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। সামাজিক অবিচ্ছিন্ন অবস্থা বা লকডাউন চালিয়ে যেতে হবে না। কারণ সেটা কোনো ক্রমেই বেশিদিনের জন্য বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নয়। আসন্ন বছরগুলোতে আমাদের আরও সাবধানতার সাথে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। ভাইরাসটির আচরণ, গতিপ্রকৃতি জানতে হবে। এর মধ্যে আশা করা যায়- ভ্যাকসিন ও ওষুধ আবিষ্কৃত হবে।
আর্থ সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক নীতি পরিবর্তনের দিকেও নজর দিতে হবে। কোভিড-১৯ লকডাউনটি বায়ুমণ্ডল ও প্রকৃতিকে শুদ্ধ ও পরিষ্কার করেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে বায়ু দূষণের সমস্যাটি মোকাবিলায় তেমন কিছু করতে পারবে না। বায়ু দূষণের মধ্যে জনগণ শ্বাসতন্ত্রের রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। কারণ দূষিত বায়ুমণ্ডল সংক্রমণের জন্য সহায়ক। তাই প্রকৃতি আমাদেরকে একটি ভবিষ্যৎ নির্মল বিশ্বের পরিকল্পনা করার তাগিদ দিচ্ছে। একইসাথে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে একে ঢেলে সাজাতে হবে। সাথে আনতে হবে কিছু আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন।
একইসঙ্গে নজর দিতে হবে ব্যক্তিগত জীবনধারার পরিবর্তনের। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, চোখে মুখে আঙুল দেয়া, কলম পেন্সিল দাঁত দিয়ে কামড়ানো, আঙুল জিহ্বায় লাগিয়ে কাগজ উল্টানো বা টাকা গোনা ইত্যাদি বাজে অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। ঘরের বাইরে মাস্ক পড়তে হবে এবং কোনো কাজ করার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ন্যূনতম দৈনিক ৬ বার হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। ধুমপান, মদ্যপান পরিহার করতেই হবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি
মন্তব্য করুন