করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই এমনকি সাধারণ ছুটিতেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় সারা দেশে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। 

জরুরি বিচারিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি জাতির এই ক্রান্তিকালে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদার, দুবৃত্তদের অপতৎপতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং রয়েছেন। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ জনগণের হক আত্নসাৎকারী ও বিপদগামী প্রভাবশালীদের স্বপ্রণোদিত হয়ে বিচারের আওতায় এনে সরকারের কার্যক্রমে সহায়তা এবং বরাবরের মত জনগণের হক রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। সময়ের দাবি মিটিয়ে পরবর্তীতে ভার্চুয়াল আদালত চালু হওয়ার পর বর্তমানে দেওয়ানি, ফৌজদারিসহ সব ধরনের আদালত ভার্চুয়ালি বিচারিক সেবা প্রদান করে গেলেও ই-জুডিসিয়ারির অনুপস্থিতি তথা আদালতসমূহ ডিজিটাইজেশনের আওতাভূক্ত না হওয়ায় জনসমাগম এড়িয়ে ও শারিরীক উপস্থিতি ব্যাতিরেকে বিচারপ্রার্থী জনগণকে সবধরনের বিচারিক সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের আদালতগুলোকে ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। 

ই-জুডিসিয়ারি চালু করতে 'সাক্ষ্য আইন' সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে ই-জুডিসিয়ারি চালুর প্রাক্কালে সাক্ষ্য আইনের পাশাপাশি, দেওয়ানি কার্যবিধি, সিআরও সংশোধনসহ শতবর্ষপুরনো বিচার ব্যবস্থা সংস্কারপূর্বক তা যুগপোযোগী করা জরুরি। বিশেষ করে বিদ্যমান মামলা জটের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ও দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে স্বল্প সময়ে সহজতম পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী জনগণকে বিচারিক সেবা প্রদানে দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বেশকিছু উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, মামলা দায়ের ও এডিআর শাখা ও বিচার শাখার প্রবর্তন করা। অস্বাভাবিক সংখ্যক মামলা দায়ের ঠেকাতে ও নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে প্রতিটি সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে একজন বিচারকের নেতৃত্বে মামলা দায়ের ও এডিআর শাখা এবং অপর একজন বিচারকের নেতৃত্বে বিচার শাখা নামে দুটি পৃথক শাখার প্রবর্তন করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, মামলা দায়ের ও এডিআর শাখার প্রধান কাজ হবে অস্বাভাবিক হারে মামলা দায়ের ঠেকানো এবং বিকল্প পদ্ধতিতে দ্রূত ও স্বল্প খরচে বিরোধ নিষ্পত্তিকে ত্বরাণ্বিত করা। ছোটখাট ও সহজেই সমাধানযোগ্য বিরোধগুলোকে প্রচলিত বিচার পদ্ধতির মুখোমুখি না করিয়ে মীমাংসা করা ফেলা। দেওয়ানি মোকদ্দমার প্রচলিত বিভিন্ন ধাপের মধ্যে মোকদ্দমা গ্রহন, সমন জারি, জবাব দাখিল, এডিআর ও বিচার্য বিষয় গঠন এই ৫টি ধাপের পাশাপাশি ডিক্রিজারি মোকদ্দমা নিয়ে কাজ করবে মোকদ্দমা দায়ের ও এডিআর শাখা।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের তথ্য মতে ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১৬৫.৩৩৭ মিলিয়ন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার কারীর সংখ্যা ১০৩.২৫৩ মিলিয়ন। এর মধ্যে ৯৫.১৬৮ মিলিয়ন লোক মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ফলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, প্রাপ্ত বয়স্ক মোট জনসংখ্যার অন্ত্মত ৮০% লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। তাই প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি মোবাইল ফোন এবং ই-মেইলের মাধ্যমে সমন জারি করা হলে তা মামলা জট ও দীর্ঘসূত্রিতা লাঘবে ফলপ্রসূ হবে।

চতুর্থত, আদালত ভিত্তিক বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি যভ এডিআর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। দেওয়ানি বিরোধের ক্ষেত্রে যেদিন আদালত ভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দিন ধার্য থাকবে সে ধার্য তারিখে পক্ষদ্বয়সহ আইনজীবীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করে বিবাদীর উপস্থিতি ব্যর্থতায় একতরফা এবং বাদীর উপস্থিতি ব্যর্থতায় মামলা খারিজের বিধান করে সংশোধনী আনা জরুরি।

পঞ্চমত, জারি মোকদ্দমা দায়ের, দখলী পরওয়ানা ইস্যু, পুলিশ স্কট নিয়োগ, দখল প্রদান বা দেওয়ানি কারাবাসের মাধ্যমে জারি সম্পন্ন ইত্যাদি যাবতীয় কার্যক্রম এডিআর শাখার অধীনেই সম্পন্ন হবে। আদালতের নাজির পুলিশ স্কটসহ দখল প্রদানে ব্যর্থ হলে, সহকারী জজ (দায়ের ও এডিআর) স্বয়ং দখলী কার্যে উপস্থিত থেকে জারি নিশ্চিত করবেন। দখলি কার্য সম্পাদনের সময় তিনি প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে গন্য হবেন। এক্ষেত্রে নাজির, পুলিশ স্কটের ফি এর মত সহকারী জজের ফি ডিক্রিদার সরবরাহ করবেন।

ষষ্ঠত, চূড়ান্ত শুনানীর স্তরে ডকুমেন্টস সংগ্রহ করতে গিয়ে সময় ক্ষেপণ  হয়। তাই চূড়ান্ত শুনানীর পর্যায়ে এসে ডকুমেন্টস সংগ্রহ ও উপস্থাপনের জন্য সময় প্রদান না করা এবং ৩০ ধারায় তদ্বীর গ্রহণের ধাপেই পক্ষদের বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োজনীয় সকল ডকুমেন্টস দাখিল করার বিধান করতে হবে। সপ্ততম, আরজি ও জবাবের বক্তব্য হুবহু বাদী এবং বিবাদীর জবানবন্দি হিসেবে লিপিবদ্ধ করার ফলে আদালতের অনেক সময় ব্যয় হয়। 

এই দুই পক্ষের জবানবন্দি আদালত স্বয়ং লিপিবদ্ধ করার পরিবর্তে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্য গ্রহণ পদ্ধতির মতো টাইপকৃত জবানবন্দি গ্রহণের নিয়ম দেওয়ানি আদালতেও চালু করা যেতে পারে। শুধু দালিলীক সাক্ষ্য প্রদশর্নীকরন এবং বাদী ও বিবাদীর জেরা লিপিবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহন শুরু হবে। এতে করে আদালতের অনেক কর্মঘন্টার সাশ্রয় হবে। তবে বাদী এবং বিবাদী পক্ষের অন্যান্য স্বাক্ষীর ক্ষেত্রে জবানবন্দি ও জেরা উভয়ই আদালত কর্তৃক লিপিবদ্ধ করতে হবে।

এছাড়া অন্তবর্তীকালীনসহ পেটি বিরোধের ক্ষেত্রে সিলিং অন্তবর্তীকালীন প্রতিকারসহ কিছু ছোটখাট বিরোধের ক্ষেত্রে জেলা জজ আদালতের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিধান করা হলে দেওয়ানি মোকদ্দমার নিষ্পত্তি দ্রূততর হবে।

উন্নয়নের মহাসড়কে দেশের অগ্রযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়তে ই-জুডিসিয়ারি প্রবর্তন ও বিচার ব্যবস্থার সময়পোযোগী সংস্কার প্রয়োজন। সেই পথ ধরে মামলাজটসহ সব প্রতিকূলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি সক্ষম, আধুনিক ও শক্তিশালী বিচার বিভাগের প্রত্যাশায় আমরা সবাই।

লেখক: সহকারী জজ ও বিচারক, পারিবারিক আদালত, রংপুর