করোনা থেকে দ্রুতই যে মানুষের মুক্তি নেই, আগের অবস্থায় পুরোপুরি ফিরে আসতে যে কমসে কম কয়েক বছর লাগবে - সে বিষয়ে সকলেই একমত। এর যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধাক্কা - তা আমরা সামলাবো হবে কী করে? 

দেখা গেছে, পৃথিবীতে যুদ্ধ বা মহামারীর মত দুর্যোগগুলো একদিকে যেমন মানুষের জন্য নিদারুন দুঃখ-কষ্ট বয়ে নিয়ে এসেছে তেমনি আবার নতুন শক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের সুযোগও সৃষ্টি করেছে। কেননা এই ধরণের পরিস্থিতি বিভিন্ন জাতির প্রকৃত শক্তি ও দুর্বলতাগুলো সকলের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বেঁচে থাকার তাগিদেই আলস্য ঝেড়ে কঠোর পরিশ্রমের পথে ঠেলে দেয় এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিতে বাধ্য করে।

করোনা দেখিয়ে দিয়েছে যে শিক্ষিত ও ধনবান শ্রেণি কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টতা পরিত্যাগ করলেও শেষ পর্যন্ত কৃষিই দুর্যোগের দিনে বাংলাদেশর জন্য প্রধান আশ্রয়স্থল। করোনার কারণে কারখানাগুলো যখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন মাঠভরা সোনালী ধান, সবুজ সবজি আর পুকুর ভরা রূপালী মাছ নিয়ে কৃষি অপেক্ষা করছিল। কৃষির কারণেই বাংলাদেশ করোনাকালীন অর্থনীতি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয়।

কৃষিখাতে বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই ভালো করছে, যদিও উৎপাদনযোগ্য ভূমি, পানির সহজলভ্যতা - ইত্যাদি সত্বেও বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন অনেক দেশের চেয়ে কম। যেমন, অস্ট্রেলিয়ায় হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন হয় ৯.১ মেট্রিক টন, মিসরে ৯.৩ মেট্রিক টন আর বাংলাদেশে মাত্র ৩.০ মেট্রিক টন। তবে বাংলাদেশের কৃষকদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুর্বল বিপনন ব্যবস্থা, যার ফলে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। ক্ষেত্র বিশেষে কৃষক যে দামে সবজি বিক্রি করে তার পাঁচ থেকে সাতগুণ দাম দিয়ে ক্রেতাকে সবজি কিনতে হয়। কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে দামের পার্থক্য শতকরা একশত ভাগ হলেও কৃষকের আয় বর্তমানের চেয়ে চারগুণ বেড়ে যাবে। কৃষি বিপননের ক্ষেত্রে সরকারকে কার্যকরভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

একইভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদন বিষয়ক পূর্বাভাসের ক্ষেত্রেও আমরা মারাত্মক অবহেলা করে থাকি। এর ফলও পোহাতে হয় কৃষককে। বাম্পার ফলন হলেও তার ক্ষতি, ফলন কম হলেও তার সমস্যা। 

পেঁয়াজের দাম ২৫ টাকা থেকে ২০০ টাকা হওয়ার পর আমরা জানতে পারি, প্রতিবেশী দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হয়েছে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। কৃষি পূর্বাভাস ঠিক মত কাজ করলে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য চাষাবাদের বিষয়টি যেমন পরিকল্পনা মাফিক করা যায় তেমনি আমদানি পরিকল্পনাও এমনভাবে করা যায়, যাতে দেশে সংকট তৈরি না হয় বা কোন একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে না হয়।

কৃষি বিপণন ও পূর্বাভাসের কার্যকর ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা গেলে একদিকে যেমন কৃষকের আয় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে, ভোক্তা পর্যায়ে কৃষি পণ্যের দাম কমে যাবে, তেমনি কৃষিতে অধিক লাভের কারণে সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তশালী অংশ কৃষিতে আগ্রহী হবে, যার ফলে কৃষিতে বিনিয়োগ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে। যে দেশে প্রায় চার কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে সে দেশে হাজার বছরের পুরাতন হাতিয়ার দিয়ে কৃষিকাজ কতদিন চলবে?

করোনা একদিকে যেমন আমাদের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছে তেমনি এ খাতে একটা বড় রকমের প্রবৃদ্ধির সুযোগও তৈরি করেছে। করোনার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ডাক্তারদের বাইরে যে বিশাল একটি জনবল সম্পৃক্ত রয়েছে, তাদের প্রতি আমরা যথাযথ গুরম্নত্ব দিইনি। আন্ত্মর্জাতিক মান অনুযায়ি ডাক্তার-নার্স-হেলথ টেকনিশিয়ানের অনুপাত ১:৩:৫ হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশে ১:০.৫:০.২৫।

নার্স, হেলথ টিকনিশিয়ান ও মেডিকেল এটেনডেন্ট জাতীয় স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতার পাশাপাশি তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বীকৃতি, আর্থিক অবস্থা এবং সামাজিক মর্যাদার অবস্থাও খুব খারাপ। অথচ একজন রোগীর হাসপাতালে অবস্থানের সময়ের একশ ভাগের এক ভাগ সময় মাত্র ডাক্তারের সেবা প্রয়োজন হয়, বাকি সময় প্রয়োজন হয় নার্স ও মেডিকেল এটেনডেন্টের সেবা।

করোনার ফলে স্বাস্থ্যখাতে বিশাল প্রবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ২০১৮ সালে ভারতে বাংলাদেশিরা ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪২,৫০০ কোটি টাকা চিকিৎসা বাবদ ব্যয় করেছে। এই রোগীরা এখন দেশেই চিকিৎসা নিবেন। ফলে ৪২,৫০০ কোটি টাকা দেশে থেকে যাবে, যা ব্যয় হবে নতুন হাসপাতাল তৈরি ও কর্ম সংস্থানে। বর্ধিত রোগীকে দেশে চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য আমাদের অল্পদিনে প্রচুর সংখ্যক নার্স ও মেডিকেল অ্যাটেনডেন্ট তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ রাজধানীকেন্দ্রীক হওয়ার কারণে করোনা ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। করোনার কারণে যেহেতু মানুষ ঢাকা বিমুখ হয়ে যাচ্ছে, ঢাকায় নানা ধরণের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে, তাই ঢাকার বাইরে ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বিকেন্দ্রীকরণের অবস্থা তৈরি হয়েছে। শিল্পে বাংলাদেশের হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থাকলেও আমরা খুব সহজে উৎপাদন করা যায় এমন পণ্যও আমদানি করছি। এমনকি দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে এলইডি বাল্ব, সুইচ, গ্যাসের চুলো, স্যানিটারি মালামাল তৈরি করে নিয়ে এসে নিজেদের নামে চালাচ্ছে। পেন ড্রাইভ ও পাওয়ার ব্যাংকের মত প্রযুক্তিপণ্য তৈরিতে বড় কোন স্থাপনা বা বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। তরুণরা নিজেদের বাড়িতেই এইসব তৈরি করতে পারে।

এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেয়া যেতে পারে। সরকার একটি প্রকল্প নিতে পারে যার কাজ হবে কী কী ধরণের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কোন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাতে কী ধরণের জনবল, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, কত বিনিয়োগে কত মুনাফা হবে - ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত ম্যানুয়াল তৈরী করা, এই সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরীতে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা সহায়তা প্রদান করা, প্রয়োজনে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়া এবং প্রচারণার মাধ্যমে তরম্নণদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। প্রযুক্তিপণ্যের দিকে প্রাথমিকভাবে জোর দিতে হবে, কেননা, তরুণরা এদিকে সহজে আকৃষ্ট হবে এবং এই পণ্যগুলোর বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

সশরীরে হাজির হয়ে মিটিং করা এবং ফাইল নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করা আগামী বেশ কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্যঝুকিপূর্ণ থাকবে। এ কারণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইফাইলিং ব্যাপকভাবে চালু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি অনলাইনে মিটিং, ট্রেনিং - ইত্যাদির অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ইপেমেন্টের ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। সরকারি কর্মচারি ও পেনশনারগণ ইএফটির মাধ্যমে বেতন, ভাতা, পেনশন ইত্যাদি পাচ্ছেন। সরকারি ও বেসরকারি খাতে ইএফটি ও রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টের মাধ্যমে ইপেমেন্টের শতভাগ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। মোবাইল ব্যাংকিং এর কমিশনের হার কমিয়ে এর ব্যাপক বিস্তার ঘটানো দরকার।

দুর্যোগের ছদ্মবেশে করোনা সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুযোগ নিয়ে এসেছে, তাকে দ্রুতই কাজে লাগানো প্রয়োজন।

লেখক: সিনিয়ার আইটি পরামর্শক, অর্থ বিভাগ