শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কার্বন নির্গমন। কলকারখানা থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড যেমন উদগীরণ হচ্ছে তেমনি আমাদের বিলাস সরঞ্জাম থেকে কিংবা প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে প্রকৃতিতে যোগ হচ্ছে গ্রীনহাউস গ্যাস। এসব গ্যাস প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও এর প্রভাব নিয়ে মানুষের শঙ্কার শেষ নেই। কিন্তু, তাই বলে এসব পরিবেশ ও প্রকৃতি বিনাশী গ্যাস নির্গমন যে বন্ধ হয়ে গেছে তা নয়, ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনও চলছে সমান তালে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ প্রতিবেশের মাঝে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রথম বলি সংকটাপন্ন উদ্ভিদের প্রজাতি, বন্য পশু এবং বাস্তুসংস্থানে পরস্পর নির্ভরশীল প্রাণী। পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তিত অবস্থার সাথে যেসব প্রাণী খাপ খাওয়াতে পারছে না তাদের কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর বাকীরা বিলুপ্তির পথে। জীব বৈচিত্রের পরিবর্তনের দোলচালে কখনো হারিয়ে যাচ্ছে কিছু প্রাণী আবার কখনো গবেষকদের তালিকায় উঠে আসছে নতুনদের নাম যার মধ্যে আছে সংক্রমণশীল ভয়ংকর কিছু অনুজীবও।

ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স কমিটির ২০০১ সালে দেয়া এক মতামতে জানা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং সংক্রামক রোগের বিস্তারের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে, তবে এ সম্পর্ক অনেকটা রোগ-নর্দিষ্ট এবং সময় ও স্থানের উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন কিছু অঞ্চলের কোথাও সংক্রমনের প্রবণতা হ্রাসও করতে পারে কিংবা নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগের প্রবণতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

মানুষ অবশ্য আগে থেকেই অনুধাবন করত যে, জলবায়ু কিংবা ঋতুর পরিবর্তনে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের প্রকৃতি পরিবর্তন হয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে গবেষকরা মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে, সংক্রমণশীল রোগ ছড়ানোর জন্য কিছু এজেন্ট দায়ি। রোমান অভিজাতরা ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষা পেতে প্রতি গ্রীষ্মে পাহাড়ে অবস্থিত রিসোর্টে অবস্থান করতেন। 

বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটানোর জন্য যেসব অনুজীব কাজ করে তাদের আকার ও প্রকৃতি হয় ভিন্ন ভিন্ন। কিছু কিছু রোগ সৃষ্টিকারী এজেন্ট সময়ের সাথে সাথে নিজেদের পরিবর্তনও করে নেয় এবং সাথে সাথে সংক্রমণের পদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটজোয়া এবং কিছু বহুকোষী পরজীবী। বিবর্তনের চক্রে এসব জীবানুর কেউ কেউ মানব প্রজাতিকে একচেটিয়া পোষক হিসেবে বেছে নিয়ে মানব শরীরে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এর বাইরে কিছু জীবানু যারা ‘জুনোস’ তারা প্রকৃতিতে বিভিন্ন মাধ্যমে (যেমন পানি) অবস্থান করে। কিছু জীবানু মানব শরীরে এক থেকে অন্যের মাঝে সরাসরি সংক্রমিত হয় আবার কিছু আছে যারা বাহকের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে অধিকাংশ জীবানু তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অথবা বাহক পেলেই কেবল মাত্র মানবদেহে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। যেমন, এডিস মশা যে ঋতুতে বেশি প্রজননের সুযোগ পায় ঠিক সে সময়ে ডেঙ্গু বাহকের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে পোষকের দেহে ভর করে।

বাহক বা ভেক্টরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া রোগের ক্ষেত্রে বাহকের বেঁচে থাকা কিংবা বাহক পোষকের সংস্পর্ষে আসার ওপর রোগের বিস্তার নির্ভর করে। যেমন এডিস মশা যদি তার উপযুক্ত পরিবেশে প্রজনন ক্ষেত্র না পায় তাহলে বংশ বিস্তার করতে পারেনা। দেখা যাচ্ছে বর্ষাকালে জমে থাকা পানিতে কিংবা দীর্ঘ সময় কোনো স্থানে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা তার ডিম ফুটাতে সক্ষম হয়। এসব ক্ষেত্রে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রজনন কমে গেলে এক্ষেত্রে বাহকের সংখ্যা কমে যায় ফলে রোগের বিস্তার কমে যায়। এছাড়াও বাহকের দেহে রোগ সৃষ্টিকারী অনুজীবের সুপ্তিকাল,অনুকুল জলবায়ু, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, দিনের আলোর সময়কাল সহ আরও অনেক প্রভাবক অনুজীবের সংক্রমণে ভূমিকা রাখে। কোনো  কোনো ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাত, সংক্রামক অনুজীবগুলোর পরিবহনকে প্রভাবিত করে আবার তাপমাত্রার পরিবর্তন এদের বেঁচে কিংবা টিকে থাকাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ঐতিহাসিকভাবে জলবায়ু পরিস্থিতির সাথে সংক্রামক রোগের বিস্তারের প্রমাণও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত উপমহাদেশে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব এবং জলবায়ুর চরম অবস্থার মাঝে সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এলনিনোর প্রভাবের পরবর্তী সময়ে ম্যালেরিয়ার  প্রাদুর্ভাব পাঁচগুণ বেড়ে যায়। এছাড়াও গত শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতের পাঞ্জাবে ম্যালেরিয়ার যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় অতিবৃষ্টি ও আর্দ্রতাকে যা মশার প্রজননে সহায়তা করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দীর্ঘ খরাও জীবানুর বাহকদের বংশবৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়। ১৯৯৯ সালে মধ্য আটলান্টিক যুক্তরা্ষ্ট্রে ওয়েষ্ট নাইল ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, গরম ও শুষ্ক গ্রীষ্মের পরপরই আরেকটি উষ্ণ শীতের আগমন ঘটার কারণে দ্রুত পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটে যা ওই অঞ্চলে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সহায়তা করেছিল।

করোনা মহামারীর উৎস, সংক্রমণ ও বিস্তারে পরিবেশের প্রভাব নিয়ে রয়েছে নানা মতামত। করোনা মহামারিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো ভূমিকার খবর এখন পর্যন্ত না পাওয়া গেলেও বিভিন্ন আবহাওয়ায় এর সংক্রমণ ও প্রভাব নিয়ে বিস্তর মতামত ও বিতর্ক চলছে। কেবল মাত্র দীর্ঘ গবেষণা থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত পরিবর্তনগুলোর অন্যতম, যা মানব সম্প্রদায়ের উপর সংক্রামক রোগের বিস্তারে প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যাই হোক না কেন, জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা প্রতিদিন যে নিয়ামকগুলো বায়ুমণ্ডলে ছাড়ছি সেগুলো বন্ধ করতে হবে আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার তাগিদেই। না হয় জলবায়ুর পরিবর্তনে বিভিন্ন মহামারিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনকে করবে সঙ্কটাপন্ন।

লেখক: অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

saifullahasm@yahoo.com