- চতুরঙ্গ
- প্রবাসীদের অবদান যেন ভুলে না যাই
প্রবাসীদের অবদান যেন ভুলে না যাই

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যেমন সব সম্পর্ক ও পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে, তেমনই যেন বদলে দিয়েছে প্রবাসীদের ব্যাপারে অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি।
অস্বীকার করা যাবে না যে, প্রবাসে করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু দেশে ফিরে কোনও কোনও নিকটাত্মীয়ও যে আচরণ করেছেন, তা প্রত্যাশিত ছিল না। অথচ বিদেশে থাকলেও সবসময় প্রবাসীদের বুকে থাকে বাংলাদেশে। অনেকে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব পেলেও তার হৃদয়টা বাংলাদেশের পলিমাটিরই থেকে যায়। পদ্মা পাড়ের ছেলে আমি। পদ্মার জলে গোসল করার দৃশ্য আজও আমাকে বিমোহিত করে। ঘোলাটে পানিতে স্নান করার স্মৃতি এখনও জীবন্ত। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার তীরে বেড়ে উঠা আমি জীবনের তাগিদে ঘর বানিয়েছি প্রশান্তের পাড়ে। প্রশান্তের তীব্র গতিশীল স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছি। জীবন যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেছি এখানে। এর মধ্যে এসে হানা দিয়েছে করোনা যুদ্ধ।
আমি জানি একদিন এই যুদ্ধের অবসান ঘটবে, আর যুদ্ধে আমাকে জিততেই হবে। এই যুদ্ধের ফলাফলই নিয়ে আসবে আগামী দিনের সুন্দর পৃথিবী। গড়ে উঠবে সভ্য ও সভ্যতার মহা জাগতিক শক্তি। প্রশান্ত পাড়ের মানুষগুলো অনেক সুন্দর ও সাজানো। প্রকৃতি যেনো তার সকল প্রেম এখানে উজাড় করে দিয়েছে। সাবলীলভাবে ও নান্দনিক ভঙ্গিতে সাজানো হয়েছে এখানকার আকাশ বাতাসকে। এই যেনো প্রকৃতির মহা উল্লাসে ভরপুর একটি জাগতিক প্রদর্শনী চিত্র। করোনা চলে যাবে এবং আবার আমরা ফিরে পাব প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার হারানো দিনগুলো।
এখানকার মায়াবী মুঙ্কর পরিবেশ আমাকে আগলে রাখে। তারপরও মা এবং মাতৃভূমির প্রতি টান এবং ভালোবাসা কখনো কমে না। আমি মনে করি, প্রতিটি প্রবাসীর কানে ভেসে আসে এক জাদুর বাঁশি। সেই বাঁশি প্রতিনিয়ত আমাদের ডাকে দেশের পানে। অনেকেই আছেন বংশ পরম্পরায় প্রবাসে থাকেন, দেশে পাঠান বৈদেশিক মুদ্রা। তা আমাদের দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে কাজে লাগে।
আমি নিজেও ছোটবেলায় মায়ের আদরে বড় হয়েছি। বাবার সান্নিধ্য তেমন পাইনি। কারণ বাবা ছিলেন রেমিটেন্স যোদ্ধা। জীবিকার তাগিদে বাবাকে দেশের বাহিরে কাটাতে হয়েছে বছরের পর বছর। কখনো কখনো বাবার মলিন কন্ঠে বলতে শুনেছি অজানা অনেক কষ্টের কথা। তবুও তিনি অবিচল ও অটল ছিলেন। নিজের জীবনকে বিসর্জন দিয়ে অনেক পরিশ্রম করে অর্জিত টাকা মাসে মাসে পাঠিয়ে দিতেন। টাকা পেয়ে উল্লাসে মেতে উঠতাম। অপেক্ষার প্রহর গুনতাম বাবা কখন বাড়ি আসবে কিন্তু অপেক্ষার শেষ হতোনা কখনো। কারণ বাবা চাইলে বাড়ি আসতে পারতেন না। তিনি কাজ করতেন মধ্যপ্রাচ্যে। শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য সেখানে মানবাধিকারের বালাই ছিল না। কিন্তু বাবা কখনো হাল ছাড়েননি, কারণ তিনি তো রেমিটেন্স যোদ্ধা। তার রেমিটেন্স পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের হাতিয়ার। বাবার মতো হাজারো কোটি প্রবাসী প্রিয়জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অনেক দূরে সারা জীবন কাটিয়ে দেন।
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পিছনে প্রবাসীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রান্তরে প্রবাসীদের ভূমিকা স্পষ্টত অথচ এই প্রবাসীরাই আজ সবচেয়ে অবহেলিত। প্রতি পদে পদে তারা বঞ্চনার শিকার। তাদেরকে শুনতে হয় শতাব্দীর নিকৃষ্টতম বাণী। তাদের নিরাপত্তার বালাই নেই, নেই কোনো ভাতা। বাবার পথের পথিক আমিও একজন রেমিটেন্স যোদ্ধা। দেশকে ভালোবেসে দেশের অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত অবদান রেখে যাচ্ছি। জাতি হিসেবে আমাদের মূল্যবোধ ধরে রাখতে হলে প্রবাসীদের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। প্রবাসী মানে শুধু ফরেন রেমিটেন্স নয়। প্রবাসী মানে বাংলার লাখ কোটি পরিবারের প্রাণ। দুঃসময় একদিন কেটে যাবে। কিন্তু সুসময়ে প্রবাসীদের অবদান যেন আমরা ভুলে না যাই।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
মন্তব্য করুন