কভিড-১৯ আমাদের গতানুগতিক অনেক কিছুকেই পরিবর্তনে বাধ্য করেছে এবং সর্বোপরি আমাদের বিশ্বাসে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। যদিও কভিড-১৯ এর সব সমস্যা এখনো পুরোপুরি আমরা বুঝে উঠতে পারছি না, তবু মোটাদাগে কয়েকটি সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায়- স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যা।

আশঙ্কার কথা হলো, পৃথিবীর সব দেশই উল্লেখিত তিনটি সমস্যার মুখোমুখি, তবে মাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। আবার সব দেশকেই সমস্যাগুলোকে একই সঙ্গে সমাধান করতে হবে। কিন্তু আর এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলো, সমস্যাগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সব দেশই দ্রুততম সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কভিড-১৯ পূর্ববর্তী সময়ের ন্যায় গতিশীল করতে চাইলেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সেটা করার পথে এক বিরাট অন্তরায়।  

উল্লেখ্য যে, ৬৬ দিন পর বাংলাদেশ সাধারণ ছুটি উঠিয়ে নিলেও সব কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনেই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। অপরপক্ষে, কভিড-১৯ এর কারণে, পৃথিবী ব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাওয়ায় পরিবেশের গুণগত মানে পরিবর্তন এসেছে এবং অনেকটা অনাকাঙ্খিতভাবে মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমেছে। কিন্তু কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে শুধু অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে প্রবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন করলে তা জলবায়ূর জন্য হুমকিস্বরূপ হবে এবং আমাদের বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের লক্ষমাত্রা অর্জনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কাজেই, উল্লেখিত সমস্যাগুলোকে সমাধান করা জটিল। 

ইতোমধ্যে প্রায় সব দেশই বেশ বড় আকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন অতীতের অর্থনৈতিক সংকটের সময় থেকে ভিন্নগতিতে হবে তা বলা যায় নির্দ্বিধায়। বাজারে প্রতিষেধক টিকা না আসা পর্যন্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে যাবে একথা নিশ্চিত। কভিড-১৯ পরবর্তী পৃথিবী যে অন্যরকম হবে তা কিছুটা আঁচ করা যায় আমাদের বদলে যাওয়া কাজের ধরন থেকে, যেমন আন্তর্জাতিক ফুটবল লীগের খেলাগুলো হচ্ছে দর্শকশূণ্য স্টেডিয়ামে।  

বছরের পর বছর যে লোকগুলো বিভিন্ন কোম্পানির প্রবৃদ্ধি ও মুনাফা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে তারা আজকে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন এবং কেউ কেউ এরই মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন। এমন অবস্থায়, বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলোতে, কর্মীদের কয়েক মাস ধরে রাখার মতো জরুরি তহবিলের অনুপস্থিতিতে আমাদের অবাক হতে হয়। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাকরি না থাকাতে এবং রোজগারের অভাবে ঢাকা শহর থেকেও কিছু পরিবার বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীতে আমরা এমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নামক মাপকাঠিতে বিচার হয়। ফলে, প্রায়শই, আমরা জনকল্যাণের কথা ভুলে যাই। ক্রমান্বয়ে, এ ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে মাপকাঠি হিসেবে মানুষের কল্যাণকেও বিবেচনায় নিলে পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তন আসবে। তবে মূল সমস্যাগুলো যদি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা না করা হয় এবং কেবলমাত্র বিচ্ছিন্নভাবে সমাধান করা হয়, আমরা হয়তো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবো,  কিন্তু আমরা সক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে ভঙ্গুরই থেকে যাবো যেটা আমরা কভিড-১৯ এর মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি।    

পক্ষান্তরে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কভিড-১৯ সেটা আমাদের বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য খাতের দিকে তাকালে, এ খাতের সীমাবদ্ধতাগুলো বেশ চোখে পড়ার মতো। এমনকি ডাক্তার, নার্স এবং অন্য সেবা প্রদানকারী কর্মীরা পি.পি.ই. ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রীর অভাবে প্রায় সব দেশেই ভুগেছেন। সুতরাং, দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি, এ ধরনের মহামারি ভবিষ্যতে মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, দক্ষতা এবং সক্ষমতা বাড়াতে হবে। 

২০০৮-এর অর্থনৈতিক সংকটের চেয়ে এবারের সংকট আলাদা হলেও, তা থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বিবেচনায় নিলে, ২০০৮ এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বেশ জ্বালানি নির্ভর এবং প্রচুর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক মন্দার ফলে ২০০৯ সালে ৪০০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণ কমলেও, ২০১০ সালে এসে তা ১.৭ বিলিয়ন টন বেড়ে যায়। কভিড-১৯ এর প্রভাবে, এ বছর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও, তাতে খুব বেশি সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না, কেননা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার সঙ্গে পৃথিবীব্যাপী এ নির্গমণ হার বাড়বে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এ কারণে, বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে যারা মাত্রাতিরিক্ত দূষণকারী তাদের নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে যাতে অর্থনৈতিক পুণরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় তারা দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়।  

আলোচনার শুরুতে যেমনটি বলছিলাম, কভিড-১৯ তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সমস্যার জন্ম দিয়েছে যা ফলপ্রসূভাবে সমাধান করতে হলে বিভিন্ন দেশের নীতি নির্ধারণে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। আমরা সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণে কী পদক্ষেপ নিচ্ছি তাই আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দিকনির্দেশনা দেবে। এ প্রসঙ্গে, অনেকেই নতুন পৃথিবীর কথা ভাবছেন যা গতানুগতিক পৃথিবীর চেয়ে আলাদা ও উন্নত হবে এমনটি প্রত্যাশা তাদের। আমরা যদি সেটা সত্যকার অর্থেই চাই, তাহলে, কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে পুরুদ্ধারে পুরোপুরি মুনাফাভিত্তিক, ব্যক্তিগত সম্পদ কেন্দ্রিক এবং প্রবৃদ্ধি নির্ভর উন্নয়ন থেকে খানিকটা বেরিয়ে এসে আমাদের সচেতনভাবে অর্থনৈতিক দিকের সাথে সামাজিক ও পরিবেশগত মাপকাঠিতে মনোযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিটি বিনিয়োগ যেন গতানুগতিক বিনিয়োগের তুলনায় সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রতিদান দিতে পারে। অবশ্যই এ উদ্দেশ্য সফল করতে হলে, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।     

লেখক : প্রকৌশলী ও পরিবেশ অর্থনীতিবিদ; সিনিয়র এডভাইজর হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত।