পুরো বিশ্ব এখন অদৃশ্য দানবের দাপটে জর্জরিত। মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর হাহাকার সমেত অদূর ভবিষ্যৎ। খোদার ওপর খোদকারি মানুষের ক্ষমতা শূন্যের কোটায়। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোও চরম অসহায় এই করোনা নামক বিধাতার অভিশাপে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছেন প্রাণহারা মানুষ। নামিদামি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় দিবারাত্রি শ্রম বিনিয়োগ করছে এই মহামারি রোধের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। এখনও সুখবর দিতে পারেননি কেউ। বরং বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের কান্ডারি ডব্লিউএইচও'র বার্তায়ও প্রতিদিন পাল্টানো বোলে হতাশার সুর বাজছে।

ইউরোপ-আমেরিকায় আপনা প্রাণ বাঁচা মুহূর্ত এখন। কোভিড-১৯ আসার আগে ইউরোপের রাজনীতিতে জাতিবাদী ও বিশ্বায়নবাদীর আখড়া ছিল। করোনাকালে সেই ভেদ ঘুচে গেছে অনেকটা। অতি জাতীয়তাবাদীরাও এখন উপলব্ধি করছেন যে, সংকটকালে কোনো দেশ একা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। অন্যদিকে বিশ্বায়নবাদীদের ধারণা ট্রাম্প, পুতিন ও শি জিনপিং যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন সত্যিকার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠা মুশকিল। সহসা নিস্তারের কোনো সুখবর তাই আপাত দিবাস্বপ্ন। নগর পুড়িলে দেবালয় রক্ষা পায় না- এই সত্যটি যেন পুনর্বার প্রমাণিত। প্রায় চার মাস ধরে চলা আমাদের দেশে আকস্মিক এক খড়্‌গ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে করোনাকাল। বহুমাত্রিক সংকটে আবর্তিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

চাকরি হারানোর তালিকায় যুক্ত হয়েছেন মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষ। টিভির পর্দায়, খবরের পাতায় এসব মানুষের মলিন চেহারাগুলোতে বিষাদের চিহ্ন। চিরচেনা কাঙ্ক্ষিত শহরে জীবনের বাকি সময়টা আর পার করা হলো না। সন্তানের পড়ালেখার উর্বর ভূমি থেকে বিতাড়িত হতে হলো এক বুক জ্বালা নিয়ে। কারণ, চাকরি ও ব্যবসা হারানো তাদের ঢাকায় আর কোনো কাজ নেই। তাই ব্যয়বহুল শহরে থাকার বায়না বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। সমাজে সম্মানের জায়গাটুকু খসে পড়ল ক্ষণিককালের এক নোটিশে। যে প্রতিষ্ঠানকে জীবনের চাইতেও ভালোবাসতেন, যে চেয়ারে কখনও একটি মাছিও বসতে দেননি সেই জায়গাটা তিনি আর ধরে রাখতে পারলেন না। সময়ের সিংহভাগ অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় স্ত্রী, সন্তানের জন্য তা অবশিষ্ট রাখার ফুসরত পাননি। আজ তার সময়ের অভাব নেই। সময়ের ভারেই তিনি এখন ক্লান্ত। কী করবেন, কোথায় যাবেন তার নিশানা নেই জীবনে। এই বয়সে নতুন করে ঠাঁই পাওয়ার আশাও সুদূরপরাহত। তাই বাধ্য হয়েই মূলে ফেরা, অন্যভাবে নিরুপায় হয়ে।

ছেলেমেয়ের ক্রন্দনে বাতাসে বিষাদের ভার। প্রদীপ নিভু নিভু বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি নামক সোনার হরিণটি টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত আছেন অনেকেই। কর্তার হুকুম যে কবে নেতিবাচক হবে তার খোরাক হয়েছে দুশ্চিন্তা। বোনাস পূর্ণিমার চাঁদ কিংবা গরিবের ঘোড়ারোগ-যৎসামান্য বেতন চাওয়ার যেন ন্যায্য অধিকার নেই। শেয়ার মার্কেটের মতো পতন হয়েছে বেতনের অঙ্ক। আরও কমবে কি-না নির্ভর করছে নির্ধারকের ওপর। কয়েক মাস অর্থকড়ি না পেয়েও আশার তরী হালকা বাতাসে পাল তুলছেন অনেকেই। জীবন যেন হঠাৎ খসে পড়া এক নব অধ্যায়। বাস্তবতাই এখন নিয়তি হয়ে উঠেছে সবার। মনের কথা ব্যক্ত করার কাছের মানুষও যেন যোজন দূরে। হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশের সপ্রকাশিত মানুষ দূরে সোস্যাল ডিসট্যান্সের অজুহাতে। প্রযুক্তির সহায়তায় ভার্চুয়াল সংজ্ঞাপন যেন স্টাইলের ওপর ফ্যাশনের ছটা। এটা জীবন নয়, জীবনকে ক্লিনিক্যালি বাঁচিয়ে রাখা। ভয়-ভীতি, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিপতিত জীবনে প্রাণ আছে বটে তাতে গতি মন্থর। বিকল্প পথহীন মোড়ানো জীবন। ভেতরে ভেতরে হা-হুতাশে ক্রন্দনের সুরে মুহ্যমান বিলাপ। করোনায় অবধারিত জীবনের দহনকাল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়- এই দিন যাপনের গ্লানি/এই প্রাণ ধারণের গ্লানি/ সহে না সহে না আর।

করোনার প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে। ইতোমধ্যে নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমানো মানুষ আবার ঘরে ফিরেছে খালি হাতে। ডলার, ইউরো, দিনার প্রতি মাসে পাঠানোর পরিবর্তে সে নিজেই এসেছে টাকার অঙ্কে ভাগ বসাতে। শ্রম মজুদ আছে কিন্তু বিনিয়োগের নূ্যনতম পথ তার জন্য খোলা নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক সেবা খাতে সেবাপণ্য লেনদেন না হওয়ায় এই সংকট আরও চরম আকার ধারণ করেছে। অনানুষ্ঠানিক সেবা খাতে লাখ লাখ কর্মীর বেকার হওয়ার পেছনের গল্পটা আরও লম্বা হচ্ছে করোনার কারণে।

করোনার মধ্যেও প্রকৃতির করাল গ্রাস চলমান। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডব বুঝিয়ে দিল প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা। বন্যায় উত্তরের মানুষের সীমাহীন ভোগান্তির অন্ত নেই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-ই এখন এই বানভাসি মানুষের নিয়তি। প্রতিবার সামান্য বন্যা হলেই ঘরবাড়ি, জমিজমা হারা মানুষের যে ক্রন্দন শোনা যায়, এবার তা কানে আসার পথ নেই। টেক্কা দিয়ে করোনার থাবা তার চাইতে বেশি বিস্তার লাভ করায় আগেই তাদের মুখের ভাষা অন্তরের ভাষা হয়ে গেছে। বিধাতার কাছে আরজি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের। সেই ফরিয়াদ যদি কোনো মানবের কর্ণগহ্বরে পৌঁছায় তবেই তাদের ব্যবস্থা। সামান্য হলেও এবারের যাত্রায় রক্ষা, যাকে বলে প্রাণে বাঁচা। এভাবে প্রতি বছর মানুষ নানামাত্রিক কারণে তাদের অস্তিত্বকে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখছে। কিন্তু জীবনমান হ্রাস পায়, হয় বেকার এবং সর্বশেষ পরিণাম নিঃস্বতর জীবন। খবরে তাই আমরা দারিদ্র্যের এই বিনাশ সংবাদ দেখতে পাই, মানব উন্নয়ন সূচকে ১৩৮তম স্থানে বাংলাদেশ। এখানে জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

করোনায় লকডাউন, ঘরে বন্দি থাকায় সবচেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সল্ফ্ভ্রম রক্ষায় তাদের ভাগ্যে জোটে না একরতি ত্রাণ। কেউ এগিয়ে আসে না মানবিকতার হাত প্রসারিত করে। অন্তরের আগুন জলে দাউ দাউ করে। জন্মই যেন তাদের আজন্ম পাপ। কানাডা বা ডেনমার্কের মতো বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার স্টেট হলে মানুষ এতটা অসহায় হয়ে পড়ত না প্রতি বছর। অসহায় না হলে বড় লোকরা ছোটলোক বলে যে গালি দিতে পারবে না, তার জন্যই আয়োজন। কাজেই এই নেপথ্যের নায়কেরা তো কলকাঠি ঠিক করে রেখেছে ত্রাসের রাজ কায়েমের জন্য। সাধারণ মানুষ কীভাবে রেহাই পাবে এই নিষ্পেষণ থেকে। না, পাবে না, কারণ এ বিশ্বে তাদের বেঁচে থাকার কী দরকার? মানিকবাবু তাদের উদ্দেশ্যে আগেই বলে গেছেন, ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লিতে, এখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বিপদকালেও কিছু মানুষের মন টলেনি অসহায় মানুষের জন্য। ত্রাণ হরিলুট, সুরক্ষা সামগ্রী নিম্নমানের তৈরি করে জীবনকে আরও অন্ধকারে পতিত করার হেনপ্রয়াস দেখা গেল কতিপয় মানুষরূপীর মাঝে। করোনাকালীন মেডিকেল চিকিৎসায় বিশেষ তহবিলে ভাগ বসালো লুটেরারা। ছবির ফ্রেমে বন্দি মাতলামিতে জননেতারা কাঁচা ধান কেটে বাহাদুরি দেখাতে ছাড়েননি। অন্নহীন মানুষের চাল, ডাল, তেল মেরে দেওয়ার পাঁয়তারায় চেয়ারম্যান-সদস্য। এ পর্যন্ত সত্তরজনের বেশি ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও পৌরসভার নির্বাচিত সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সমাজে তারা গণ্যমান্য ও সুপরিচিত মানুষ। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজের সর্বস্ব দিয়ে মানুষের মুখের হাসি ফোটানো দূরের কথা, রক্ষকই ভক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হলো তারা। সামান্য লোভের বশে তারা জলাঞ্জলি দিল নিজের অস্তিত্বকে। প্রমাণ করল পুনর্বার-চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। আর শুনবেই বা কেন, শুনলে যে বড় দালানকোঠা আরও গগণচুম্বি হবে না। তাদের কর্ম দেখে মনে হয়, তারা অমর, পৃথিবী তাদের স্থায়ী নিবাস। আর যদি ভুলে মারাও যায় তাহলে এসব সম্পত্তি সঙ্গী করেই পাড়ি দেবে ওপারে। অথচ প্রকৃত জ্ঞানী ও ক্ষমতাবানরা ঠিকই আঁচ করতে পারেন তাদের নিঃস্বতার কথা। তাই ইতিহাসে বিখ্যাত ঘটনা স্থান করে নেয় এভাবে- মৃত্যুর সময় নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ১৬ সভাসদের ওপর শেষ উপদেশ- দেশের সেরা ১০ জন ডাক্তার যেন তার শবদেহ বহন করে গোরস্তানে নিয়ে যায়, কফিনের দুদিকে তার হাত দুটো যেন ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং শবযাত্রার সময় তার অর্থসম্পদ যেন মাটিতে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। কেন এই উপদেশ দিয়েছিলেন নেপোলিয়ন, তা বোধ করি সবারই জানা।

বিরূপ বিশ্বে মানুষ একা- এ আপ্তবাক্য ভুলে গিয়ে পাহাড়সম সম্পদ গড়ায় নিয়োজিত অনেকেই। কিন্তু করোনায় আক্রান্তের স্বজনরা প্রমাণ করেছে কেউ পাশে নেই তাদের। তাই তো কখনও জঙ্গলে ছেলে ফেলে এসেছে মাকে, বোন নিরুদ্দেশ হয়েছে ভাই পানি পানি বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেও, প্রেমিকা সটকে পড়েছে প্রিয়তমের দুরবস্থা দেখে। স্বামী উধাও হয়েছে স্ত্রী, সন্তানকে বিপদে ফেলে। এ যেন এক অজানা বিশ্ব। রবিবাবুর চিরবাস্তবতায় প্রকাশিত-পৃথিবীতে কে কাহার?

করোনার থাবার পেছনে পৃথিবীকে অবৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহারের কথাই বলছেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীতে একক রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পারমাণবিক বোমার ব্যবহার, কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ, জ্বালাও পোড়াও হিংস্রতা, ইকোসিস্টেমকে ধ্বংস করার হীন ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ এই মহামারি। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও সমূহবিপদ হাজির হবে মানবজাতির জন্য। কাজেই এখন থেকেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত না থাকলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে আরও ঘোরতর অন্ধকার। তাই প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। করোনার শিক্ষা তাই হওয়া চাই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনা থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষা আমরা নিচ্ছি না। বরং ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে যুদ্ধের ডামাঢোলের বাজনা এখনই দোরগড়ায়। চীন-ভারত যেভাবে তাদের সীমান্ত নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে তার ফল যুদ্ধের দিকেই ধাবমান। মানুষের নৈতিকতার সীমানা প্রাচীরে যে সহসাই ঘুন ধরবে এমন ধারণা করাও অদূরদর্শিতা। কারণ, করোনার মধ্যেও বাইরে ও অন্তরমহলে যে বিভীষিকাময় আবহের আগমন বার্তা দেখা যাচ্ছে তাতে সেই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ়তর করে তুলছে বৈকি। করোনার দহনকাল শেষ হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু গরিব, অসহায়, চাকরিচ্যুত মানুষের সমাজের দহনকাল শেষ হবে না কোনোদিন। এই নির্মোঘ সত্যের বারতায় জীবন চলবে। তবে এই অপসংস্কৃতির বিস্তার বন্ধ হলে মানুষের লালিত স্বপ্নগুলো টিকে থাকবে আরও বিপুল স্বপ্ন নিয়ে। নিখাদ ভালোবাসায় মুক্ত হবে করোনা একদিন, ফিরে আসবে সুদিন- এই প্রতীক্ষায় আশায় বুক বাঁধবে মানুষ যুগ যুগান্তরে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।