পানি, বাতাস, মাটি ইত্যাদি জড় পরিবেশের অংশ; আর জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদ এগুলো স্বাভাবিকভাবেই জীব পরিবেশের আওতাধীন। পরিবেশের অবশ্য অরেকটি রূপও আছে। সেটি হলো সামাজিক। সামাজিক পরিবেশের আওতায় পড়ে পারস্পরিক সম্পর্ক। মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কও পরিবেশকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেমন- কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের সূচনা। যার মাধ্যমে ষাটের দশকে বিশ্বে প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়াস চালানো হয়েছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি, অদক্ষতাসহ নানা কারণে এই বিপ্লবের ফলে সামাজিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়েছিল।

পরিবেশ ও প্রকৃতিকে এমনভাবে কখনোই জয় করা ঠিক নয়, যাতে তা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। কেননা মানুষ কিন্তু একদিকে সামাজিক জীব, অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, সৃষ্টির শুরু থেকেই আসলে মানুষ পরিবেশকে জয় করেছে, উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণ তৈরি ও ব্যবহার করতে শিখেছে। মানুষ প্রতিনিয়ত নিজ অবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে প্রয়াসী। কিন্তু উন্নয়ন এবং প্রকৃতিকে জয় করার এই কাজটি যদি প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে না করা হয়, তাহলে মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বাধ্য।

আমরা জানি সার্স, সিভেট, নিপাহ ভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। মার্স ভাইরাস উট থেকে, সোয়াইন ফ্লু শূকর থেকে এবং বার্ড ফ্লু মুরগি বা পাখির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে। ফলে পরিবেশবাদী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এটা জোর দিয়েই বলেছেন, প্রকৃতি হরণ ও হননের ফলে যে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে, তার ফলে বন্যপ্রাণী মানুষের সংস্পর্শে আসায় এসব বিপত্তি হয়েছে।

সর্বশেষ কভিড-১৯ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাত্রারই প্রভাব। পরিবেশের প্রতি এই ধ্বংসাত্মক মনোভাব আমাদের অস্তিত্বকেই আজ বিপন্ন করে তুলছে। প্রসঙ্গত, আমরা সবাই জানি, কভিড-১৯ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে কাঁচা মাংসের বাজারের কর্মীর মাধ্যমে প্রথম ছড়ায়। যেখানে প্রচুর বন্যপ্রাণীর কাঁচা মাংস বিক্রি হতো। ফলে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, যখন মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশকে যথেচ্ছভাবে লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে, তখনই এসব প্রাণী মানুষের সংস্পর্শে আসে, আর তখনই অন্যান্য অনেক সমস্যার পাশাপাশি নানা রকমের রোগেরও সৃষ্টি হয়। কভিড-১৯ যার মধ্যে অন্যতম।

প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের এক সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, প্রকৃতিতে এখন কত প্রজাতির প্রাণী বেঁচে আছে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই মানুষের। যে কারণে ঠিক কত প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট হিসাব দেওয়া কঠিন (সূত্র :বিবিসি ২৮ নভেম্বর, ২০১৯)। এ ছাড়া জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বিশ্বে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনাঞ্চল। পৃথিবী থেকে যদি এভাবে দ্রুত বনাঞ্চল ধ্বংস হতে থাকে, তাহলে তার পরিণাম সত্যিই ভয়াবহ হতে বাধ্য। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশের মোট আয়তনের তুলনায় যেটুকু বনভূমি রয়েছে তা অনেক কম।

প্রতি বছর বন্যা ও খরার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে। দখল, দূষণসহ বিভিন্ন কারণে নদীপ্রবাহের গতি স্বাভাবিক না থাকায় কৃষিকাজসহ নানাক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, বন্যায় ভেসে যাচ্ছে অনেক সাধ আর স্বপ্ন। এর সাথে এখন ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের এবং নতুন নতুন রোগব্যাধি। আর এ সবকিছুর ফলে উন্নয়ন বিঘ্নিত হচ্ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে। সে কারণে পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন হওয়া সবার জন্য অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই দেশের পরিবেশগত সমস্যা এবং এসব সমস্যার প্রকৃত কারণ জানা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সেগুলো আমাদের অনুভূতি ও উপলব্ধিতেও আনা দরকার। তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে মানুষের কাজে লাগানোর পরেও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হতে পারে।

প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য কী দেয়নি আমাদের? বেঁচে থাকার উপাদান, ভালো লাগার ও ভালো থাকার উপাদান। সবকিছু যেন উজাড় করে দিয়েছে আমাদের। তাই প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করাটা এখন সময়ের দাবি। আর এই আঙ্গিকটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রেখে দেশব্যাপী নতুন একটি জাতীয় শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করে সবাই মিলে একযোগে সে লক্ষ্যে এখনই কাজ শুরু উচিত বলেও আমি মনে করি।

আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস (গত ২৯ এপ্রিল, ২০২০) বিশ্বনেতাদের প্রতি একটি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'করোনা পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।' সেদিকটিতে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখনই।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে- রিভেঞ্জ অব নেচার। প্রকৃতি কখনোই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় না, নেতিবাচক হয় না। তাহলে এই প্রবাদটা কেন ব্যবহূত হয়? কারণ প্রকৃতিও মানুষের মতো প্রাণের দাবি রাখে। সহনশীলতা ও সম্প্রীতিবোধের মাত্রা হয়তো তারও আছে। তাই সময়ের প্রয়োজনে কিংবা তাগিদে তাকেও কখনও কখনও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে হয়। দেড়শ' বছর আগে বলা ফ্রেডেরিখ অ্যাঙ্গেলস কিংবা একশ' বছর আগে রবীন্দ্রনাথের বলা প্রকৃতির প্রতিশোধের কথাটা ইতিহাসে যেন বারবারই সত্যি হয়েছে। আর সেই ধরনের সত্যি আমরা চাই না। আসুন, এবার আমরা কভিড-১৯ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে প্রকৃত অর্থেই সুন্দর একটি মৈত্রীর বন্ধন রচনা করি।


লেখক: সদস্য, নির্বাহী পরিষদ, নগর গবেষণা কেন্দ্র (সিইউএস, ঢাকা)
bidhancp@gmail.com