- চতুরঙ্গ
- সৈকতের ত্রাণ তৎপরতার অসামান্য গল্প
সৈকতের ত্রাণ তৎপরতার অসামান্য গল্প

প্রবাদ আছে ফেল করা ছাত্ররাই নাকি ফ্রান্সকে বাঁচিয়েছিল। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর নীতিতে সংঘটিত ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের ব্যাকবেঞ্চার আর ঝরে পড়া বহু ছাত্র যৌবনের স্পর্ধা নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হয়ে উঠেছিল বিপ্লবী। স্বাধীনতার ফুল ফুটাবার জন্য ১৯৭১ সালে শহীদ রুমীর মতো কত তরুণ বিদেশ-বিত্তের মোহমায়া ত্যাগ করে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে আত্ম বলিদান করেছে। বিভিন্ন জাতির জীবনে বিদ্রোহের, যুদ্ধের আর বিপ্লবের টগবগে দিনগুলো প্রতিদিন ফিরে ফিরে আসে না। তবে এবার আমাদের জীবনে নেমে এসেছে করোনার এক করাল দুর্দৈব। এই মহামারির দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনি এক ব্যাকবেঞ্চার তানভীর হাসান সৈকতের মানবিক তৎপরতার গল্প বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে জাতিসংঘ।
গত ১৯ আগস্ট 'বিশ্ব মানবিক দিবসে' জাতিসংঘ এ বছরের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণদের মধ্যে 'রিয়েল লাইফ হিরো' বা বাস্তব জীবনের নায়কদের কীর্তিগাথা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় চারজন নায়ক খুঁজে পেয়েছে জাতিসংঘ। তাদের একজন হলো এই সৈকত। এই নিরন্নের কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে টানা প্রায় চার মাস ধরে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, পকেটের তের হাজার টাকা সম্বল করে, প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে দুই বেলা আহার তুলে দিয়েছে সৈকত ও তার ডাকে সাড়া দেওয়া ওর একঝাঁক দয়ালু ও সাহসী সতীর্থ। ধীরে ধীরে বন্ধু, শিক্ষক ও শুভাকাক্ষীরা সৈকতের এই খাদ্য-উদ্যোগে হাত বাড়িয়ে দেন। সৈকতরা গরিবের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার কাজকে মহামারির দিনেও একটা উৎসবে পরিণত করে। করোনায় যখন মৃত্যুর ভয়ে সবাই ধুঁকছে, সৈকতরা তখন আধমরাদের খাবার দিয়ে জীবন উদ্যাপনে মাতছে। খবরে দেখা গেছে, এক নারী খুশিতে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, 'এই খাওন না পাইলে আমরা মইরা যাইতাম।' যখন ত্রাণ চুরি আর গরিবের বরাদ্দ আত্মসাতের খবরে সারাদেশে বহু খলনায়কের কুৎসিত চেহারা ধরা পড়ছে, সেই সময় ক্ষুধার্ত ও লাঞ্ছিতদের জীবন-বাস্তবতায় নায়ক হয়ে উঠেছে এ দেশেরই এক অতি সাধারণ যুবক তানভীর হাসান সৈকত। দুঃসময়ে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্বকে পেরিয়ে, বৃহৎ সমাজের দুঃখের ভাষা বুঝে যে কাজে নেমে পড়ে, বাস্তবে সে-ই তো নায়ক।
একজন শিক্ষকের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা হলো জীবনের সপক্ষে কোনো ছাত্রের আশাজাগানিয়া রূপান্তর চাক্ষুষ করা। থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে আমি সৈকতকে ওর সেই প্রথম বর্ষ থেকে দেখেছি। শ্রেণিকক্ষের চার দেয়ালে বন্দি থেকে টিপিক্যাল মুখস্থনির্ভর ছাত্রছাত্রীদের মতন পাঠ নিতে গিয়ে সে স্নায়ুতে চাপ অনুভব করেছে। কোনো এক সেমিস্টারে হঠাৎ শুনি সে ড্রপআউট হয়ে গেছে। ছাত্রলীগে সক্রিয় থেকেও কোটা সংস্কার আন্দোলনেও সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ডাকসু নির্বাচনের দিনগুলোতে ক্যাম্পাসে ঝুলন্ত কোনো এক ব্যানারে দেখতে পাই সদস্য পদপ্রার্থী সৈকতের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি। এরপর ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে নানা কাজের ভেতর সে হঠাৎ খবরের শিরোনাম হয়। আবাসিক ছাত্রাবাসগুলোতে গণরুমের বিভীষিকা উপলব্ধি করে নিজের কক্ষ ছেড়ে গণরুমে ছাত্রদের সঙ্গে সে থাকতে শুরু করে।
এমনকি ছাত্রদের এই অমানবিক আবাসন-সংকট নিরসনে সে একপর্যায়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। তারপর গত বছরের জুলাই মাস। আমি তখন উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য যাওয়ার প্রস্তুতিতে বেশ ব্যস্ত। শিক্ষক ও বিদেশি ছাত্রদের আবাসস্থল স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলে এক বিকেলে সৈকত হাজির হলো। দেশে তখন বেশ কিছু ধর্ষণের মতো নারকীয় ঘটনা ঘটে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে জনসম্পৃক্ত নাট্যকর্মকাণ্ড করে, নারীর প্রতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে কীভাবে সচেতন ও সক্রিয় করা যায়, তা নিয়ে পরামর্শ করতে আসে। ওর কাছ থেকে এদেশের আলস্যে স্থবির তরুণরা যা শিখতে পারে তা হলো, ভাবনাকে সঙ্গে সঙ্গে কাজে পরিণত করা। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জনবহুল স্থানে ধর্ষণ ও সহিংসতাবিরোধী নাট্য পরিবেশনার মাধ্যমে তার একটা টগবগে অভিজ্ঞতা হয়। সেই অভিজ্ঞতাও আবার শিক্ষকের কাছে ভাগাভাগি করতে আসে।
আমি সৈকতের চোখেমুখে এক অন্যরকম দীপ্তি দেখতে পাই। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৌন্দর্য-পিপাসা মেটানোর জন্য যে নাটক হয়, সেগুলো তো বহুদিনের পুরোনো কায়দার সংস্কৃতি চর্চার পানসে অভিজ্ঞতার নাম মাত্র। এর বিপরীতে, জলজ্যান্ত সামাজিক ও অপরাধমূলক ইস্যু নিয়ে জনগণের সামনে উপস্থাপিত ধর্ষণবিরোধী রাস্তার নাটক হয়ে ওঠে প্রতিদিনের বাস্তবতা সম্পর্কে একটি প্রতিবাদী শিক্ষার মাধ্যম। সংকটের সময় সাংস্কৃতিক কাজ কেবল বাস্তবতার ছবি তুলে ধরে না, হাতুড়িপেটা করে বাস্তবতাকে বদলানোর উপযুক্ত শিক্ষাটাও জনগণের হাতে তুলে দিতে পারে। তা ছাড়া, রাষ্ট্রের মধ্যে বাস করে আমরা সব সমস্যারই একটা পুলিশি অথবা আইনি সমাধানের দিকে তাকিয়ে থাকি। যেন শামসুর রাহমানের কবিতায় বলা নাগরিক জীবনের ঝাঁকের কই হয়ে ঝাঁকে মিশে যাই। বিকল্পের দিকে সহজে আমাদের চোখ যায় না। শ্রেণিকক্ষে নয়, জীবন-বাস্তবতায় করা নাটকের এসব শিক্ষা সৈকতকে আরও টগবগে করে।
বিশেষত ফেসবুকে অনুপস্থিতির কারণে, ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরে লকডাউনের মধ্যে অনেকের মতো আমিও উদগ্রীব ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রছাত্রীদের সর্বশেষ কুশল জানতে।
বিভাগেরই প্রাক্তন আমার এক ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম একদিন নিজেদের কাজের পাশাপাশি আরও জানায় সৈকতের ত্রাণতৎপরতার অসামান্য গল্প। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের টিএসসি থেকে সে আবার ছুটে গেছে সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষের কাছে সাধ্য অনুযায়ী ত্রাণ নিয়ে। সৈকত যেন কবিতা আর গানের সেই রানার।
কবি সুকান্তের রানার খবরের বোঝা বয়ে ছুটে চলে, আর সৈকত খাবারের বোঝা বয়ে ছুটে চলে তাদের কছে, যাদের খাবার বড় দরকার। সে বলে, 'শুধু দায়িত্ব থেকে নয়, ভালোবাসা থেকে কাজ করছি।' যে ভালোবাসতে জানে না, সে তো বেঁচে থেকেও মৃত মানুষ। জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রগুলোর প্রতাপে আমাদের দেশে যে ভোক্তাসমাজ তৈরি হয়েছে, তারা তো কেবল ভালোবাসা বলতে আরেকটি ভোগ্যপণ্যকেই বোঝে। অথচ ভালোবাসা নৈতিক এবং রাজনৈতিক। ভালোবাসার অন্য নাম হলো সমানুভূতি, যে অনুভূতির মাধ্যমে একজন রাজনৈতিক বা সমাজকর্মী নিজেকে প্রসারিত করে সমাজের বঞ্চিত অংশ পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। এভাবে ব্যক্তির মন হয়ে ওঠে দেশের জনগণের হূৎস্পন্দন। আগামীদিনে বাংলাদেশের উত্থানের গল্প সৈকতদের এই নিঃশর্ত ভালোবাসা থেকেই লেখা হবে। সৈকতদের পায়ের আওয়াজ যত তীব্র হবে, জাগ্রত বাংলাদেশের মাথা তত উঁচু হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; পিএইচডি গবেষক, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ড
বিষয় : তানভীর হাসান সৈকত
মন্তব্য করুন