আমরা শিগগিরই নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পদার্পণ করতে যাচ্ছি, যা একই সঙ্গে অহঙ্কার এবং ক্ষেত্রবিশেষ 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ' বিষয়। ক্রমাগত ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা ও শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রগতি ঠিক রাখতে হলে আমাদের লাগবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরিবেশবান্ধব কয়েকটি বিকল্প উৎস রয়েছে যার প্রথমটি হলো সৌরবিদ্যুৎ, দ্বিতীয়টি বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এবং শেষটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ।

ওয়াশিংটনভিত্তিক নিউক্লিয়ার এনার্জি ইনস্টিটিউটের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুসারে ১০০০ মেগাওয়াট (গড়) বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রায় ৭৫ বর্গকিলোমিটার, বায়ুবিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৬০ বর্গকিলোমিটার জায়গা দরকার, যেখানে নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের ক্ষেত্রে মাত্র ১.৩ বর্গকিলোমিটার জায়গাই যথেষ্ট।

নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের মূল্য বায়ুবিদ্যুতের চেয়ে কম ও সৌরবিদ্যুতের চেয়ে বেশি, অবশ্য পার্থক্য খুব বেশি না। তাই স্থানের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে আমাদের মতো ছোট দেশের জন্য নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎই প্রযোজ্য। যদিও তা প্রথম দুটির তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দুর্ঘটনাজনিত নিউক্লিয়ার বিকিরণের কারণে।

যদি বিকিরণ ঝুঁকির কথা বিবেচনা করি, তাহলে নিউক্লিয়ার চুল্লি না বসিয়েও আমরা বিকিরণ ঝুঁকিতে আছি। কারণ আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যেমন ভারত, চীন ও পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। নিউক্লিয়ার বিকিরণজনিত কোনো দুর্ঘটনা ওই দেশগুলোতে ঘটলে, দুর্ঘটনাস্থলে বাতাসে তেজস্ক্রিয় কণা (তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ) ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা, দুর্ঘটনাস্থল থেকে আমাদের দেশের দূরত্ব, ওই সময়ে বাতাসের দিক ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে নিঃসরিত তেজস্ক্রিয় কণাগুলো আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের থাকুক বা না থাকুক, বিকিরণ-ঝুঁকি আমাদের সবসময় আছে।

তবে যেটা চিন্তার বিষয় সেটা হলো, আরও বেশি পরিমাণ দক্ষ ও অভিজ্ঞ নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ (গবেষক বা বিজ্ঞানী), নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজনীয়তা যা একান্তই আবশ্যক ছিল প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই। এ ক্ষেত্রে বিদেশনির্ভরতা আমাদের জন্য নেতিবাচক হতে পারে। নিউক্লিয়ার চুল্লি স্থাপনে আমাদের আরও কিছু সুবিধা রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গবেষণা, চুল্লি পরিচালনা সক্ষমতা তৈরি, নিউক্লিয়ার মেডিসিনের জন্য তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ উৎপাদন, ব্রেইন টিউমারের জন্য বোরন নিউট্রন ক্যাপচার থেরাপি (বিএনসিটি) সংক্রান্ত সেবা গবেষণার মাধ্যমে চালু ইত্যাদি। এ ছাড়া নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন শাখায় উপযুক্ত গবেষক তৈরিতেও এই চুল্লি বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখি।

নিউক্লিয়ার চুল্লির কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে মাপতে হবে বাতাসে ভেসে বেড়ানো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কর্তৃক প্রদত্ত প্রতি ঘণ্টায় ডোজের পরিমাণ। প্রাথমিকভাবে সেই ডোজের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে চিহ্নিত করতে হবে দুর্ঘটনার মাত্রা, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার হার এবং দিক। এসব পরিমাপের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। এই তেজস্ক্রিয়তার ডোজ মাপার প্রাথমিক একটি যন্ত্র হলো ডজিমিটার। সাধারণত চুল্লির ভেতরে কন্ট্রোল রুম থেকে শুরু করে পুরো পরিসীমাজুড়ে অনেক ধরনের এবং অনেকগুলো ডজিমিটার থাকে। ছোট দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে হয়তো পরিসীমার ভেতরে স্থাপিত ডজিমিটারগুলোই যথেষ্ট। কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা যদি বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাকে দূষিত করে ফেলে, সে ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কীভাবে পরিমাপ করবে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ? নিশ্চয় পোর্টেবল ডজিমিটার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে না। সেজন্য থাকতে হবে নির্দিষ্ট বিকিরণ পরিমাপক স্টেশন বা বিকিরণ পরিমাপক পোস্ট। সেই স্টেশন বা পোস্টগুলো হতে হবে ৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে। যদি সম্ভব হয় প্রতি ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে অন্তত চারদিকে চারটি বিকিরণ পরিমাপক পোস্ট থাকতে হবে, যাতে বোঝা যায় তেজস্ক্রিয়তা কোন দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তখন প্রযোজনভেদে ওই এলাকা খালি করার ক্ষেত্রে এলাকা ত্যাগের পথ নির্ধারণ করতে সহজ হবে। যেহেতু এসব মনিটরিং পোস্ট বা স্টেশন অনেক ব্যয়সাপেক্ষ, তাই প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের অন্তত ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকার মধ্যে কয়েকটি পোস্ট বা স্টেশন বাসানোর কাজ যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে।

আমরা জানি, ফুকুশিমা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকার মধ্যে সব লোকজনকে সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল। এত বিপুলসংখ্যক লোকজনকে সরিয়ে কোথায় রাখবে সেটা নিয়েও আমাদের চিন্তা করতে হবে। এতে বিপুলসংখ্যক লোকজনকে কিভাবে কোথায় সরানো হবে সেটাও একটা গবেষণার বিষয়।

মনিটরিং পোস্ট ও স্টেশনের উদাহরণ হিসেবে আমি জাপানের একটি প্রদেশ, ফুকুইয়ের মনিটরিং পোস্ট ও স্টেশনের কথা বলি যার আয়তন চার হাজার ১৯০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা সাত লাখ ৭৮ হাজার ৯৪৩ জন (জুন, ২০১৭ পর্যন্ত)। ফুকুই প্রদেশে রয়েছে পাঁচটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট এবং মোট ১১৭টি মনিটরিং স্টেশন ও পোস্ট।

এই পোস্ট বা স্টেশনগুলো ২৪/৭ ঘণ্টা আবহাওয়া পরিমাপক বিভিন্ন রাশি যেমন তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বাতাসের বেগ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণসহ বাতাসের তেজস্ক্রিয়তা মনিটর করে, ডাটা সংরক্ষণ করে এবং তাৎক্ষণিক রিডিং দেখানোর কাজ করে। তাছাড়া এসব পোস্ট ও স্টেশন থেকে এসব ডাটা সরাসরি ওয়েবসাইটে আপলোড হয়, যা সব নাগরিক যে কোনো মুহূর্তে দেখতে পারে। এভাবে মনিটরিং পোস্ট বা স্টেশনের মাধ্যমে আমরা বিকিরণ নির্গমনজনিত দুর্ঘটনাকবলিত এলাকাকে আইসোলেট করা, লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া এবং দূষণ রোধে কাজ করতে পারব। এসব মনিটরিং পোস্ট বা স্টেশনের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশের নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার খবরাখবরও পাব খুব সহজে। যদি কোনো দেশ এসব অস্বীকারও করে, তাহলেও আমরা আমাদের মতো করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারব।

আমরা জানি এপ্রিল, ১৯৮৬ সালে ইতিহাসের অন্যতম নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা, ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনার কথা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচার করেনি এবং প্রথম দিকে স্বীকারও করেনি। কিন্তু সুইডেনের ফোরর্সমার্ক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকিরণ পর্যবেক্ষণ ডজিমিটারের মাধ্যমে পরিবেশে অস্বাভাবিক রকম তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা শনাক্তের মাধ্যমে বিশ্ব সর্ব প্রথম ওই দুর্ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়, যেখানে সুইডেন থেকে ইউক্রেনের দূরত্ব ছিল এক হাজার ৫০০ কিলোমিটারের বেশি। এসব বিকিরণ পর্যবেক্ষণ পোস্ট বা স্টেশনের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে পুরো এলাকায় একটি বিকিরণ পর্যবেক্ষণ সেন্টার থাকবে, যেখানে প্রয়োজনীয় লোকবলের মাধ্যমে পরিবেশের বিকিরণ মাত্রা সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। যে কোনো জরুরি মুহূর্তে সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানানোর ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ সেন্টার থেকেই প্রথম পদক্ষেপ নেবে। এই সেন্টার হয়ে উঠবে একটি গবেষণা সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যা আমাদের গবেষণাকে আরও বেশি স্বনির্ভর করে তুলতে সাহায্য করবে।

নিউক্লিয়ার চুল্লি আমাদের হয়ে যাবে। এখন দরকার দেশি ও বিদেশি বিকিরণ-ঝুঁকি নির্ণয়, নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি গবেষণার মাধ্যমে উৎকর্ষের দ্বার উন্মুক্তের জন্য প্রযোজনীয় সংখ্যক বিকিরণ পর্যবেক্ষণ স্টেশন বা পোস্ট স্থাপন। আশা করি, কর্তৃপক্ষ এই জরুরি দিকটি বিবেচনা করে সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়