- চতুরঙ্গ
- করোনাকালে চাই ‘হাইব্রিড’ শিক্ষাব্যবস্থা
করোনাকালে চাই ‘হাইব্রিড’ শিক্ষাব্যবস্থা

ফাইল ছবি
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয় এবং তা পরবর্তীকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। যতই দিন যাচ্ছে করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমরা নতুন নতুন অনেক তথ্য পাচ্ছি। তবে করোনাভাইরাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য পেতে হয়তো আমাদের আরও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা এটুকু বলতে পারি- ১. করোনাভাইরাস মানুষের শ্বাসতন্ত্রকে আক্রমণ করে, যা অনেকের জন্য মৃত্যুর কারণও হতে পারে; ২. এই ভাইরাস মানুষের দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়; ৩. সংক্রমণের হার কমাতে হলে সংক্রমণের চেইনকে ভাঙতে হবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে; ৪. করোনাভাইরাস সাধারণত একজন ব্যক্তির মধ্যে ১৪ দিন থাকে উপসর্গসহ বা উপসর্গ ছাড়াই; ৫. এই ভাইরাস আক্রমণের উপসর্গগুলো সাধারণত শুস্ক কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, গন্ধ না পাওয়া এবং মুখে স্বাদ না থাকা ইত্যাদি; ৬. এই ভাইরাস সাধারণত বয়স্কদের জন্য, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা এবং শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা আছে তাদের বিপদের কারণ হতে পারে; ৭. এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী, বিশেষ করে যুবক ও শিশুদের জন্য করোনাভাইরাস তেমন বিপজ্জনক নয়, তবে একটু ব্যতিক্রমও আছে এবং ৮. সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে করোনা আক্রান্ত মানুষের সুস্থ হয়ে ওঠার হার ৯৮% বা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এ বিশ্বকে অনেকটাই থামিয়ে দিয়েছিল; থমকে গিয়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা, সীমাবদ্ধ হয়েছিল এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলাচল, বন্ধ হয়েছিল অফিস-আদালতপাড়া, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। একটা দমবন্ধ হওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। করোনাভাইরাসের প্রকোপ এখনও শেষ হয়নি, তবে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও সব কিছু অনেকটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আমার বর্তমান কর্মস্থল ফিনল্যান্ডে বলা যায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবকিছুই স্বাভাবিক। করোনা মহামারিতে এক দিনের জন্যও ফিনল্যান্ডে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকেনি। এর প্রধান কারণ হলো উন্নত ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি অবকাঠামো। শ্রেণিকক্ষের পড়ালেখা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনা সংক্রমণ এখন ফিনল্যান্ডে বেশ কম আর তাই ছাত্ররা শ্রেণিকক্ষে ফেরা শুরু করেছে বেশ আগেই। ভবিষ্যৎ সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে শ্রেণিকক্ষ এবং অনলাইনের সংমিশ্রণে একটা হাইব্রিড শিক্ষাদান পদ্ধতির দিকে এগোচ্ছে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা। আমার কর্মস্থল তাম্পেরে ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড স্যায়েন্সেসেও শুরু হয়েছে হাইব্রিড পদ্ধতিতে শিক্ষাদান।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ফিনল্যান্ডের এই হাইব্রিড শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারে শিক্ষা ক্ষেত্রের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়ার জন্য। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বাংলাদেশ চাইলে তাম্পেরে ইউনিভারসিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। আমি এ ব্যাপারে আমার বিশ্ববিদ্যালয় অথরিটির সঙ্গে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারি যদি বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মনে হয় আমাদের শিক্ষা খাত। অনেকদিন থেকে ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মচারীরা বাসায় বসে আছে। এতে করে জাতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যতের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে কীভাবে আমরা আমাদের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাব, যাতে ভবিষ্যতের উন্নয়নকে গতিশীল করা যায়।
করোনায় আক্রান্ত এবং তা থেকে মৃত্যুর ঘটনা এখনও ঘটে চলছে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে। কয়েকবার সাধারণ ছুটি বৃদ্ধি করার ফলে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অর্ধ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। আগামী ৩ অক্টোবর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি শেষ হতে যাচ্ছে। অফিস-আদালতপাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সব আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকার বর্তমান ছুটির মেয়াদ শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার কথা গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করতে পারে। আরম্ভটা এভাবে হতে পারে: যেমন ১. প্রথম দুই সপ্তাহ শুধু রোববার ও বৃহস্পতিবার স্কুল খোলা থাকবে; ২. তৃতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে রোববার, মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবার স্কুল খোলা থাকবে; ৩. এই সপ্তাহগুলোতে স্কুল পূর্ণ দিবসের পরিবর্তে অর্ধদিবসের কথাও চিন্তা করা যেতে পারে; ৪. এই চার সপ্তাহের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারে; ৫. মনে রাখতে হবে কোনো ছাত্র যেন জ্বর, গলাব্যথা, শুকনো কাশি নিয়ে স্কুলে না আসে এবং ৬. প্রতিটি স্কুলে সম্ভাব্য আকস্মিকভাবে উদ্ভূত কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা হাতে রাখতে হবে।
করোনা যেমন আমাদের কাছে বয়ে এনেছে অনেক ভোগান্তি তেমনি উন্মোচন করেছে অনেক উন্নয়ন সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এর মধ্যে একটা হচ্ছে শিক্ষা খাত। এই করোনাকাল হচ্ছে আমাদের উপযুক্ত সময় শিক্ষাব্যবস্থার জন্য উন্নত ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি অবকাঠামো গড়ে তোলার; যাতে করে আমাদের স্থান বা শ্রেণিকক্ষ শিক্ষা প্রদান এবং শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে। উন্নত ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি ব্যবস্থায় শিক্ষিত স্নাতকরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ইনফরমেশন টেকনোলজির বিপ্লব ঘটাতে পারবে। এতে করে এগিয়ে যাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, এগিয়ে যাব আমরা, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
মন্তব্য করুন