'পরিবর্তিত বিশ্ব স্বাস্থ্য' এ প্রতিপাদ্যটি নিয়ে প্রতি বছরের মতো ২৫ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস। ফার্মাসিস্টদের বিশ্বব্যাপী সংগঠন এফআইপি- আন্তর্জাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশন কর্তৃক গৃহীত এ বছরের প্রতিপাদ্যটি মূলত কভিড-১৯ মহামারিজনিত পরিবর্তিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে নির্ধারণ করা হয়েছে। করোনাকে লক্ষ্য রেখে আমাদের নিউ নরমাল জীবনব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। এ অবস্থায় এ বছরের প্রতিপাদ্যটি যথার্থই হয়েছে।

কভিড-১৯ মহামারি ব্যবস্থাপনা একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে সব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মডেল ভাবা হতো, মহামারি মোকাবিলায় তাদেরও দুরবস্থা ফুটে উঠেছে। উন্নত বিশ্বে মহামারি মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনে থেকে যারা মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, বায়োকেমিস্ট প্রমুখ। তার মধ্যে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট যারা হাসপাতালে সেবা দেন তাদের মূল কাজ হলো রোগীর জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণের গাইডলাইন তৈরি, রোগীকে নিরাপদ উপায়ে ওষুধ দেওয়া, ওষুধ সম্পর্কিত বিভিন্ন উপদেশ, ওষুধের কার্যকারিতা কিংবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে সঠিক ওষুধ নির্ধারণ ও তার ডোজ নির্ধারণে সহায়তা দেওয়া অন্যতম। পাশাপাশি হাসপাতালে কোন ধরনের ওষুধ রাখতে হবে, সেগুলোর সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন একজন দক্ষ গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট।

কভিড-১৯ মহামারির সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো এই রোগের কার্যকর কোনো ওষুধ এখনও পাওয়া যায়নি। ফলে সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ব্যবহার, ঘনঘন হাত ধোয়া, ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সহায়ক ওষুধ ব্যবহার করে মহামারি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন চিকিৎসক এবং গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা। বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সংঘটিত হচ্ছে যেখানে চিকিৎসকদের পাশাপাশি ফার্মাসিস্টরা কাজ করছেন। ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, যেখানে মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, ফার্মাসিস্ট, চিকিৎসক সবাই যুক্ত হয়ে দিনরাত গবেষণা করছেন।

তবে আমাদের দেশের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চিকিৎসক এবং নার্সকেন্দ্রিক। ফলে রোগ নির্ণয়ে দক্ষ লোকের অভাব, ল্যাবরেটরির স্বল্পতা, রোগীর ওষুধ নিয়ে অব্যবস্থাপনা, ওষুধের দোকান থেকে রোগীর দেদার ওষুধ ক্রয়, ওষুধের অপচয়, ওষুধবিষয়ক জটিলতা, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিলম্বিত হওয়া ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও কভিড-১৯ মোকাবিলায় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি বিষয়েও ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা না থাকায় নানান ধরনের অনিয়মের খবর হরহামেশাই চোখে পড়ে।

আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের সরাসরি সম্পর্কিত হওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি। হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট নিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে, যারা শুধু ওষুধ সংরক্ষণ ও বিতরণের সঙ্গে সংযুক্ত। আশির দশকে দেশে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের অভাবে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট দিয়ে হাসপাতাল ফার্মেসি পরিচালনার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে দেশে এখন প্রায় চল্লিশটিরও অধিক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়মিত বের হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেই এ সব গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের অর্জিত জ্ঞান হাসপাতাল ফার্মেসিতে কাজে লাগানো যেতে পারে। করোনাকালীন আমরা দেখেছি সাধারণ মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ডেপামিথাসনের মতো ওষুধ কিনে গ্রহণ করেছে। তাই চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন এবং গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের অনুমতি ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক, নারকোটিকস, অ্যান্টিসাইকোটিকস, ইনজেকশনস, আইভি স্যালাইন, হরমোন ইত্যাদি ওষুধ বিক্রি বন্ধ করার নীতিমালা অত্যন্ত আবশ্যক।

কভিড-১৯ মহামারি হয়তো তার সক্ষমতা হারিয়ে সাধারণ ফ্লু ভাইরাসের পর্যায়ে নেমে আসবে। অন্যদিকে হার্ড ইমিউনিটি কিংবা ভ্যাকসিনের কল্যাণে আমরা কভিড-১৯ মোকাবিলায় সক্ষম হবো। কিন্তু প্রাকৃতিক বিবর্তন কিংবা পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণেই হোক, এ ধরনের মহামারি সামনের দিনগুলোতে আরও আসবে। তাই, আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে গবেষণা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্নিষ্ট মহলকে স্বাস্থ্য খাতে যার যা ভূমিকা আছে, তাদের কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। অন্যথায় সারা বিশ্ব করোনামুক্ত হলেও আমরা করোনাচক্রে বাঁধা পড়ে যেতে পারি।