বাংলায় ১০টি বর্ণ লাগে 'শেখ মুজিবুর রহমান' লিখতে। এই দশ বর্ণই যেন বাংলার দশ দিক। আমাদের 'দশদিগন্ত' বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলেন বিশ্ব প্রাঙ্গণে, যেখানে তিনি জানান দিয়েছিলেন বাঙালি জাতিসত্তার কথা; আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধ সংস্কৃতির কথা।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার জন্য জেলে গেছেন। হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি নিজেদের ভূমির জন্য সংগ্রাম করেছে। একটি স্বাধীন দেশের জন্য অযুত-নিযুত প্রাণ দিয়েছে। সেই জাতির জন্য একটি দেশ এনে দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তাই বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। তিনি সেই ভাষার ঋণের কথা ভুলে যাননি। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশের মর্যাদা লাভ করে। এর আট দিন পর, ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন বাংলায়। জাতিসংঘে এটি ছিল প্রথম বাংলায় ভাষণ। এতে করে বাংলা ভাষা বিশ্বদরবারে পেয়েছে মর্যাদার আসন, এই ভাষাভাষী মানুষেরা হয়েছি গর্বিত। বিশ্ব পরিসরে এর আগে এমন করে বাংলা ভাষাকে কেউ পরিচয় করিয়ে দেননি।

বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে চেতনায় ধারণ করে লালন করেছেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছেন আত্মপ্রত্যয়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণা করে। এরপর শেখ হাসিনা যতবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে এসেছেন, ততবার বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করেছেন।

বিশ্বব্যাপী কমবেশি ৩৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। তবে বাংলা ভাষার কেন্দ্র বলতে বিশ্ব বাংলাদেশকেই বোঝে। মাতৃভাষা বিবেচনায় বাংলা এখন চতুর্থ। সংখ্যার দিক দিয়ে সপ্তম। ইউনেস্কো ২০১০ সালে বাংলাভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরেলা ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ানো হয়। বাংলা ভাষার এত গৌরব সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে তার তেমন কোনো প্রচারের ব্যবস্থা নেই।

অথচ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী শুধু ভাষার নয়, 'বাংলাদেশ' নামটির একটি ইতিবাচক প্রচার করা যেত সহজেই। কীভাবে? এ উত্তরটি দেওয়ার আগে বলে নিই তাতে দেশের কী লাভ হতো। মোটা দাগে বলতে গেলে মানুষ সব সময় তার পরিচিত গণ্ডির মধ্যে থাকতে চায়। আপনি বাজারে একটি পণ্য কিনতে গিয়ে পরিচিত দেশের পণ্যটাই কেনেন। তেমনি বিশ্ববাজারে সমমানের কোনো পণ্য যদি অপরিচিত কোনো দেশের হয়, মানুষ তাতে নির্ভর না করে পূর্বপরিচিত দেশের জিনিসে আস্থা রাখে।

কীভাবে প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বাংলাদেশের মানুষ আছে। দেশের আদলে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা জাতীয় শহীদ দিবস পালন করেন। দেশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেও প্রবাসে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ সীমিত। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে দিবসটির আয়োজন করতে বাধ্য হয়।

যদি প্রতিটা দেশে সম্মিলিতভাবে বিদেশিদের সম্পৃক্ত করে ব্যাপক আয়োজন করে করা যেত, তাহলে সে দেশের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক স্থান দখল করতে পারত। এমনটি ঘটতে পারত বিশ্ব সংবাদমাধ্যমেও। এর মাধ্যমে আমাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির কথা বিশ্ববাসী জানতে পারত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, নওগাঁর পাহারপুর বৌদ্ধবিহার ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি জেলায় কিছু না কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। শুধু বিশ্বব্যাপী প্রচারের অভাবে আমাদের পর্যটন বিকশিত হচ্ছে না। আমাদের গৌরব আর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও প্রকৃতি বিশ্বদরবারে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে পর্যটনে সুবাতাস বয়ে যেতে পারত।

প্রশ্ন আসতে পারে, সম্মিলিত আয়োজন করাটা কি এতই সহজ? হাঁ, একেবারেই সোজা। প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস বা হাইকমিশন এ কাজটি সহজেই করতে পারে। বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে সংশ্নিষ্ট দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা নিয়মিত ভাষা দিবস উদযাপনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাদের ও স্থানীয় কমিউনিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করলে, তাহলে অধিকাংশ প্রবাসীই সম্মানিতবোধ করবে কাজটি করতে। তখন অর্থনৈতিক বিষয়টিও বড় কোনো ব্যাপার হবে না। পাশের দেশ ভারত ধর্মীয় অনুষ্ঠান 'দিওয়ালি' এক সময় নিজে বড় করে আয়োজন করত। এখন আমেরিকা সরকার নিজে তা উৎসব হিসেবে উদযাপন করে। চীন সরকার তাদের নিজেদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিশ্বব্যাপী। এ সব আয়োজনে সেসব দেশের কী লাভ হচ্ছে, তা সরকার ভালো করেই জানে। এমন অসংখ্য নজির চোখের সামনে থাকার পরও আমাদের এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই।

বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত কেউ নিজে উদ্যোগী হয়ে কাজ করার চেয়ে কোনো দায়িত্ব পেলে তা পালন করতে বেশি স্বস্তিবোধ করে। এ জন্যই হয়তো কোনো হাইকমিশনার নিজে উদ্যোগী হয়ে এ ধরনের কাজ হাতে নেন না। যারা প্রবাসে সরকারিভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা প্রত্যেকেই দেশপ্রেমিক, তাতে সন্দেহ নেই। তারা প্রত্যেকে দেশের জন্য কিছু করতে পারলে গর্ববোধ করেন। সরকারের পক্ষ থেকে যদি একটি চিঠির মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা দিবসের আয়োজনটি সম্মিলিতভাবে করার কথা বলা হয়, তাহলে সরকারি প্রতিনিধিরা এ উদ্যোগ স্বাচ্ছন্দ্যে নেবেন বলেই বিশ্বাস। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও অর্থনৈতিক ও শারীরিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন।