মেপে দেখিনি, মনে হলো লম্বায় প‎াঁচ ফুটের বেশি নয়। নরম চেহারা। চুল বিন্যস্ত। সাজগোজের বালাই নেই। কণ্ঠস্বর অনুচ্চ। সন্দেহ জাগে কী করে ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রী পড়ান। সব ছাত্রছাত্রীর কর্ণকুহরে সঠিক পৌঁছায় কিনা। সম্পর্ক যেহেতু আঁটোস‎াঁটো নয়, চেপে গেলুম।

বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের শুরু ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। প্রথম পাঁচ বছর পাঁচ দিনের উৎসব। শ্রোতার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ন্ত। ভিড়ও উপচে পড়ে। ঠিক হয়, দশ দিনব্যাপী। উৎসবের আয়োজক তথা ডিরেক্টর উলরিস স্রাইবার, লেখক নন, সাহিত্যপাগল। গাঁটের কড়ি খরচ করে, এবং ধার করে, ধারে জর্জরিত হয়েও পাগলামিতে খামতি নেই। পাঁচ বছর পরে দেখা গেল, সাহিত্য উৎসব রমরমা করার জন্য নানা প্রতিষ্ঠান সাহায্যদাতা। সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও পৃষ্ঠপোষক। গত দশ বছরে এমন অবস্থা, বড় বড় ব্যবসায়ী মায় গাড়ি কোম্পানিগুলোও স্পন্সর করতে আগুয়ান। আসলে, বড় ব্যবসায়ীদের ট্যাপ ফাঁকি দেওয়ার মওকা। কুলটুর (সংস্কৃতি) সাহায্যের নামে। এসব ক্ষেত্রে ট্যাপ মওকুফ। স্পন্সরের সংখ্যা এতটাই, ২০১৬ থেকে উলরিস স্রাইবার আর কোনো স্পন্সরশিপ নিতে নারাজ। তাকেও খরচের হিসাবপত্তর দিতে হয়। বাড়তি আয়েও ট্যাপ ধার্য।

উলরিস মজার কথা কন, 'না চাইতেই মেঘবৃষ্টিজল, এখন বন্যার তোড়। ঠেলা সামলানো দায়।' শুরু থেকে উলরিসের লক্ষ্য ছিল, উৎসব হবে বৈশ্বিক দর্পণ। বলেছিলেন পহেলা উৎসবের (২০০০ সাল) সংবাদ সম্মেলনে, 'পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষাসাহিত্য উন্মোচনই আমার উদ্দেশ্য। মূল ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ, জার্মান অনুবাদ প্রাধান্য পাবে। মূল ভাষা থেকে পড়লেও ইংরেজি/জার্মান (অনূদিত) শ্রোতাদের জন্য পঠিত। শ্রোতা জার্মান। এই দেশে, সেই দেশের ভাষা সংস্কৃতির-রাষ্ট্রসমাজকে তুলে ধরা, প্রচারিত করা, সাহিত্যের মাধ্যমে, মূল উদ্দেশ্য।'

গত ১৯ বছরে (এ বছর উৎসব স্থগিত করোনার দাপটে। তবে ভার্চুয়াল কনফারেন্স ঠিকই। যোগ দিয়েছেন তিন নোবেলজয়ীসহ তিন ডজনের বেশি লেখক-লেখিকা, বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে।) উৎসবে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তর লেখক অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশের লেখকও। সবচেয়ে বেশি ভারতের। ভারতে এখন বিস্তর ইংরেজি লেখক। ব্রিটেন-আমেরিকা থেকে তাদের বই প্রকাশিত। ভারতে পেঙ্গুইন-র‌্যান্ডম হাউস, হারপার কলিন্স জাঁকিয়ে বসেছে। ভারতীয় লেখকদের বই প্রকাশ করছে। বাজারও যথেষ্ট। ভারতে প্রকাশিত বই পৃথিবীর বহু দেশে সুলভ। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে। ধারেকাছেও নেই।

উলরিস স্রাইবারের বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে যারা যোগ দিয়েছেন, অনেকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত। পুরস্কার পাওয়ার আগে। সংখ্যা এক ডজনের বেশি। সাংবাদিকতার সূত্রে তাদের সঙ্গে দেখা। পরিচয়। আলাপ। এমনকি বন্ধুতাও। বই উপহার দিয়েছেন। কার লেখা গান, স্মরণ হচ্ছে না, 'আমার দেবার কিছু নেই।'

লুইস গ্লুক উৎসবে, ২০০৭ সালে, কবিতা পাঠের পরে আলাপচারিতা। কথায় আন্তরিকতা, সহৃদয়তা। ওর কবিতা খুব ভালো লেগেছিল। ফেলে আসা দেশ, শৈশব, কৈশোর, যৌবনের প্রারম্ভ, রাষ্ট্রসমাজ, মানুষ, পারিপার্শ্বিক সবই দৃশ্যত যেন। বললুম গদগদ কণ্ঠে।

আবেগে সহমর্মী। বললেন, আমেরিকার বহুশ্রুত গানের কলি, 'হোমসুইট হোম।'

লুইসের কবিতা পাঠের আসরে (বার্লিনের আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে মাত্র ছয়টি কবিতার অনুষ্ঠান। তাও 'কবিতা রাখতে হয়, তাই।') শ্রোতার সংখ্যা ত্রিশজনও নয়। লুইসের পাঠে সাকল্যে কুড়িজন (গুনিনি তখন)। উচ্ছ্বসিত। 'ওরা আমার কবিতা পড়েছেন এর আগে? প্যারিসে মাত্র ছয়জন শ্রোতা ছিল। আমেরিকায় একটু বেশি, ত্রিশ-চল্লিশজন।'

২০১৪ সালে লুইস আবার আমন্ত্রিত। উৎসবে, পাঠশেষে, পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে, বাড়তি ঘনিষ্ঠতা। আড্ডা। ভারতীয় কবিতা খুব বেশি পড়েননি, রবীন্দ্রনাথের 'সংগ্‌স্‌ অব অকারিব'স (গীতাঞ্জলি) সেকেলে। এখন অচল।' বলেন। 'ভারতীয় কবিদের মধ্যে কালিদাস প্রিয়, হালের রামানুজ (বছর কয়েক আগে পরলোকে)। সুপাঠ্য কবি।' আরও বলেন, ''ভারতীয় মিথ 'মহাভারত' আজকের কবিতার জন্যও উৎসব।'' বলার হেতু, লুইস পুরাণকাব্যে নিজের কবিতার নব্যকথক। প্রকৃতি পরিবেশেরও। লুইস প্রকৃতিপ্রেমিক। বললেন, "বার্লিনে বিখ্যাত 'টিয়ারগার্টেন' (পাঁচ কি.মি. বনজঙ্গল বাগান) দেখব।" নিয়ে গেলুম। দেখতে দেখতে বনের মধ্যে মাঝে মাঝেই উধাও। একবার দেখি, পাইনগাছ জড়িয়ে (আলিঙ্গন) বিড়বিড় উচ্চারণে কী সব বলছেন। জিজ্ঞেস করলুম। উত্তর- 'আমাদের ঈশ্বর দাঁড়িয়ে।'

লুইস গ্লুক সাহিত্যে নোবেলজয়ী, এই আনন্দে ফোন করলুম, লুইসের ফোন সারাক্ষণই এনগেজড্‌। আচ্ছা, দু'দিন পরেও তো বলতে পারি, বাংলা ভাষার পক্ষ থেকে 'আত্মিক অভিনন্দন'।