- চতুরঙ্গ
- রাহাত খান: কথাশিল্প ও সাংবাদিকতার বাতিঘর
রাহাত খান: কথাশিল্প ও সাংবাদিকতার বাতিঘর

ফাইল ছবি
বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার ভাগ্যাকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্কের নাম রাহাত খান। সাহিত্যপ্রেমী মানুষকে তিনি তার সৃষ্টিশীল কর্ম দিয়ে মুগ্ধ করেছেন। একইভাবে সাংবাদিকতার মাধ্যমেও তিনি সংশ্লিষ্ট অঙ্গনে অমরত্ব লাভ করেছেন। এটি তার অকল্পনীয় মেধা, অসাধারণ প্রতিভা আর কীর্তিময় কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি। বাঙালি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে তার অনবদ্য কর্মময় জীবন ও অনুসৃত নীতি-আদর্শ ইতিহাসের স্মারক হয়ে চির জাগরূক থাকবে।
১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাহাত খান কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০২০ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আট দশকের বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের ঘটনাবহুল ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য সাক্ষীতে পরিণত হয়েছেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে মূলত তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল; ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও ঢাকার জগন্নাথ কলেজে তিনি অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমেই সংবাদ পত্রিকায় এবং পরবর্তী সময়ে দৈনিক ইত্তেফাকে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং ২০১৩ সালে তারই সম্পাদনায় দৈনিক বর্তমান পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বোর্ড চেয়ারম্যান নিয়োগ করে এবং এ পদে তিনি আড়াই বছর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
কথাশিল্পী রাহাত খান আশৈশব গল্পপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি যখন সবেমাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছিলেন, সেই ছোট্ট বয়সেই প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম গল্প। শৈশবেই কতটা চিন্তাশীল ও গল্পপ্রিয় ছিলেন, ভাবা যায়! সেই গল্পটি ছিল কচ্ছপ আর চিল নিয়ে; তার চোখের সামনেই চিল একটি ছোট্ট কচ্ছপকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়! ঘটনাটি তাঁকে পীড়া দেয়, তিনি চমকে যান এবং অশ্রুসিক্ত হন। এ ঘটনায় তার হদয়-গভীরে যে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়, সেটিই ছিল তার প্রথম গল্প লেখার উপকরণ। এরপর থেকেই শুরু হয় তার লেখালেখির নিরন্তর অভিযাত্রা। ১৯৭২ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অনিশ্চিত লোকালয়' নামে প্রকাশিত হয়। ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য অবদান।
রাহাত খানের সাহিত্য নির্মাণে ছিল এক অকল্পনীয় প্রতিভা। তিনি তার ছোটগল্পের ভেতরে অনায়াসে বিশাল সমুদ্র ঢুকিয়ে দিতে পারতেন; এ ছিল তার লেখনীর কৌশল ও দক্ষতা। চরিত্র চিত্রায়ণে, বর্ণনা ভঙ্গিমায় ও কাহিনি নির্বাচনে তিনি ছিলেন সুনিপুণ কারিগর। মহান মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্প তার হাতেই পেয়েছে নতুন মাত্রা। মাত্র দুই পৃষ্ঠার একটি ছোটগল্প 'দীর্ঘ অশ্রুপাত' মনে হয় সারাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা খণ্ডচিত্রের প্রতিনিধিত্ব করছে। গল্পের শেষ পাদটীকায় রাহাত খান লিখেছেন, 'এ ঘটনার দশ মাস পরের কথা। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। ঢাকা বিমানবন্দর লোকেলোকারণ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসছেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ঢাকা বিমানবন্দরের ফাঁকা নীল আকাশের দিকে ছিল সবার চোখ, কখন রাজহংসের মতন একটি বিমানের দেখা মেলে আকাশে, এই আবেগনিবিড় অপেক্ষা চলছে। বছর পাঁচেকের একটি ছোট্ট মেয়েও ছিল সেই ভিড়ের ভেতরে। সবাই ছিল আবেগতপ্ত ও উত্তেজিত। কিন্তু মেয়েটি ছিল চুপচাপ। এমন সময়ে মাইকে ঘোষণা করা হলো, আর কয়েক মিনিট, তারপরই তিনি আসছেন। ছোট্ট মেয়েটি এই ঘোষণা শুনে আমার হাত ধরল, মুখ ওপরে তুলে করুণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল- 'আমার আব্বু আসবে না?
রাহাত খান কথাশিল্পে ঢাকা নগরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির জীবনকে তুলে এনেছেন। পাশাপাশি তার দেখার চোখ, লেখার ভাষা ও উপলব্ধির চিত্ত ছিল গ্রামীণ জীবনকে কথাশিল্পের তুলিতে অঙ্কন করা। অন্যদিকে অমল ধবল চাকরির মতো উপন্যাসগুলোতে গ্রাম্য জীবন নিয়ে লিখেছেন। তিনি হে মাতবঙ্গ ও হে মহাশূন্যতে একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয় তুলে ধরেছেন। তার বইয়ের নামগুলো এক একটি কালের সাক্ষী, সময়ের আগে চলা এক মহান শিল্পীর মহিমার নিদর্শন; বইগুলোর নামই বলে দেয় এক অভিজ্ঞ মুনশির মুনশিয়ানা, যেন জীবন্ত ধ্রুপদি। যেমন- অমল ধবল চাকরি, ছায়াদম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খোলোয়াড়, এক প্রিয়দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল, হে মাতবঙ্গ, হে মহাশূন্য প্রভৃতি। উপন্যাস রচনায় তার দক্ষতার প্রমাণ মেলে 'হে অনন্তের পাখি' অধ্যয়ন করলে, যা ছিল বাংলা সাহিত্যের নগরকেন্দ্রিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক। এ উপন্যাসের উপজীব্য ও নায়ক স্বয়ং বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর। এ শহরের এক অস্থির ও বিপর্যস্ত সময়কে অবলম্বন করে তিনি এ উপন্যাসের চরিত্র চিত্রায়ণ করেছেন। ক্ষমতার মেরুকরণ, সামরিক ও রাজনৈতিক মিথস্ট্ক্রিয়ার এক নতুন সমীকরণ, গড়ে ওঠা ধনিক-বণিক শ্রেণি, যৌনতা, সন্ত্রাস ও পরিবারে ব্যক্তিত্বের সংঘাত এবং বৈচিত্র্যময় শ্রেণিপাতের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শহরের অভিনব জীবনপ্রণালির বাস্তব চিত্রই তিনি তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে। জামিল, বকুল ও মুমুর আটপৌরে কাহিনি এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও উপজীব্য হলেও তিনি এর অন্তর-প্রবাহে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও নতুন করে গজিয়ে ওঠা এক উচ্চবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস বিকশিত হয়েছে। নোমানী, তৈফুর সাহেব কিংবা শামস এ উপন্যাসের কল্পিত চরিত্র হলেও শহুরে জীবনের পরিবর্তনশীল অভিযাত্রায় বিরাজমান এ চরিত্রগুলো চিনতে কোনো পাঠকেরই সমস্যা হয় না। বিশুদ্ধ মানে উত্তীর্ণ এক উপন্যাসের যেসব নিরাসক্তি উপাদান আবশ্যক, 'হে অনন্তের পাখি' উপন্যাসে রাহাত খান তার সবই সরবরাহ করেছেন। বস্তুত, আলোচ্য উপন্যাসটি সত্যিকার অর্থে নগর জীবনের এক দর্পণ হিসেবে বিবেচিত।
রাহাত খান তার অনবদ্য কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছেন উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৩), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার (১৯৭৯), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২), ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) এবং একুশে পদক (১৯৯৬); এর মধ্যে বাংলা একাডেমি ও একুশে পদক দুটি পুরস্কারই তিনি তার সাহিত্যকর্মের জন্য লাভ করেন। তবে সাহিত্য নির্মাণ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতিভূ হিসেবে নিঃসন্দেহে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। তাই আমরা আশা করব, কীর্তিমান এ মনীষীকে রাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে যেন আমাদের ওপর অর্পিত দায় শোধ করা হয়। মরণোত্তর এই সম্মান রাহাত খানের প্রাপ্য; এতেই তার বিদেহী আত্মার প্রতি নিবেদিত হবে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মাননা। আমরা প্রয়াত রাহাত খানের জন্য মহান আল্লাহর কাছে পারলৌকিক জীবনের মুক্তি কামনা করি; পরম করুণাময় তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন।
মন্তব্য করুন