- চতুরঙ্গ
- রশীদ প্রেমিকা
রশীদ প্রেমিকা

চোখে দেখিনি, বাঁশিও শুনিনি। চিনি। ই-মেইল। বছর কয়েক আগে মেলবোর্ন থেকে যোগাযোগ করেন। মূল উদ্দেশ্য নিমন্ত্রণ। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক মেলা উপলক্ষে। সরাসরি প্রত্যাখ্যান করিনি। বলি, 'ভারতে যাবো তখন, আত্মীয়স্বজন আসবেন। অনেক দিন দেখিনি। প্রত্যেকে প্রতীক্ষারত।' শুনে, 'রশীদ হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই, ফোন নাম্বার দেবেন?' দিয়েছিলাম। পরে কী ঘটে, অজানা। মেলবোর্নের দুই বন্ধুর ফোনে শুনি, মেলা নিয়ে ঝামেলা, কমিটি থেকে ভদ্রমহিলা বাদ। বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম তাকে। রশীদ হায়দারের মৃত্যুর চার দিন পরে ফোন, কণ্ঠ শুনলাম তার।
'রশীদ হায়দারের সঙ্গে দেখা হলো না, আফসোস রয়ে গেল। দেখা হলে কয়েকটা প্রশ্ন করতাম।'
- কী প্রশ্ন, আপত্তি না থাকলে বলবেন কী?
'আপত্তি আর কী, তিনি তো চলেই গেলেন।'
- বলল।
এক. আপনারা সব ভাই সাহিত্য করেন। আপনাদের বাবা-মা কি গল্প-কবিতা লিখতেন?
দুই. আপনাদের বোনরা বাদ কেন?
তিন. রশীদ হায়দার গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটক লিখেছেন, গবেষণা করেছেন। আপনারা, অন্যান্য ভাইয়েরা কবিতা লেখেন, তিনি কেন লেখেননি?
চার. তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, না-থাকাও রাজনীতি, কিন্তু তিনি আওয়ামী-মনোভাবাপন্ন, আওয়ামী লীগার, সন্দেহ নেই। যদিও প্রকাশ্যে বলেননি কোনো লেখায়। না বললেও তার লেখালেখিতে স্পষ্ট। অনেকটাই। যেমন, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীকে নিয়ে বই লিখেছেন। আওয়ামী-মেজাজের না হলে 'স্মৃতি ৭১', 'শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ' স্বতঃস্ম্ফূর্ত সম্পাদনা করতেন না। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা নিয়ে এত লেখালেখি করতেন না। তার অনেক গল্প, উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা নানাভাবে ঘুরেফিরে দানা বেঁধেছে। আপনি বাদে আপনার বাকি ভাইরা (এর আগে বলেছেন, 'ভায়েরা')। আওয়ামী লীগে বিশ্বাসী মনে হয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলেন না। আপনি ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, এখনও কমিউনিজমে ঘোরতর বিশ্বাসী, লিখেছেন একটি লেখায়, যদিও থাকেন জার্মানির মতো ধনতান্ত্রিক দেশে। 'রশীদ সাহেব কী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন?' হেসে কই, চার নম্বরে আপনি সব কইলেন। প্রশ্নবাহুল্য।
রশীদ হায়দার ইহলোকে নেই। তার হয়ে তার জবান রচনা অসম্ভব। বললাম, এক থেকে চার প্রশ্নের উত্তর এই পয়লা, বাবা-মা সাহিত্যটাহিত্য করতেন না। দ্বিতীয়, দুই বোন মাঝেমধ্যে কবিতা লেখেন। বাকিরা কেন লেখেন না, ওদের জিজ্ঞেস করুন। তৃতীয়, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে আস্থাশীল। সরাসরি রাজনীতি না করেও আওয়ামীর প্রতি বিশ্বাসী, আওয়ামী না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। আওয়ামীর সাম্প্রতিক রাজনীতি হরেক ডামাডোলের, বেখাপ্পা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চির উন্নত শির। রশীদ হায়দার সমাজতন্ত্রে নিবেদিতপ্রাণ, ঠিক তবে, সরব ঘোষণা ছিল না। না থাকাও রাজনীতি। আওয়ামী রাজনীতির অন্তরঙ্গে সমাজতন্ত্র আছে, বৈশ্বিক চাপ, করপোরেট অর্থনীতির ছলাকলা এবং ধর্মীয় মৌলবাদের আগ্রাসনে আপাত মৌনী ছিলেন, সোচ্চার হননি, কিন্তু বিশ্বাস ছিল দৃঢ়, সূর্যকে মেঘ যতই ঘিরুক, সাময়িক। সূর্যের তেজে ধূলিসাৎ। আঁধারের পরে সূর্যালোক। চারদিক আলোকিত। উদ্ভাসিত।
সূর্য বলতে রশীদ হায়দার বলতেন, 'বাংলার অসাম্প্রদায়িক সূর্যসন্তানকুল। সূর্যসন্তানরাই মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সেনানী।' চতুর্থ, এরশাদ-বেগম জিয়ার পান্ডাকুল হাড়েমজ্জায় জানতেন, রশীদ হায়দার ভাঙবে, মচকাবে না। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী দর্শনে, সমাজতন্ত্রে একনিষ্ঠ, এই কারণে হেনস্তা বহুবার, চাকরিতে প্রমোশন হয়নি। সটান ছিল শিরদাঁড়া। বাঁকেননি কখনও, নত হননি। আদর্শে অবিচল।' আরও বলি, 'রশীদ হায়দার কতটা দৃঢ়চিত্তের, শুনুন। আপনার অজানা আরও অনেকের। জানেন শেখ হাসিনা। দ্বিতীয় টার্মে, তথা দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শেখ হাসিনা অনুরোধ করেন রশীদকে, 'স্পিচ রাইটার' হিসেবে যোগদানের। নিঃসন্দেহে লোভনীয়। পদমর্যাদায় যুগ্ম সচিব (জয়েন্ট সেক্রেটারি)। রশীদের সবিনয় প্রত্যাখ্যান। প্রত্যাখ্যান রশীদের যুক্তিতে হাসিনা শ্রদ্ধাশীল। যুক্তি কী? মৌলিক লেখক। গবেষক। যোগ দিলে দুটোই ব্যাঘাত। গোল্লায় যাবে। 'স্পিচ রাইটার'-এর কাজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়ার, তার সমস্ত কথা শোনা, প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে নানা জায়গায়, নানা সভা-সমিতিতে উপস্থিতি। ঘরে ফিরবেন কখন? পড়বেন কখন? লিখবেন কখন? গবেষণা করবেন কখন? চিন্তার স্বচ্ছতায় বাধা পড়বে নাকি? বাধা দিলে বাইরে লড়াই। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
ভদ্রমহিলা বললেন, 'এতকিছু জানতাম না। রশীদ হায়দার নমস্য। এই মানুষটি কেবল শ্রদ্ধারই নয়, আদর্শের। তিনি আমার মর্মমূলে প্রেমিক।' তার নাম রাশীদা জান্নাত। তাকে চোখে দেখিনি, তার বাঁশিও শুনিনি। তার কণ্ঠস্বরে রশীদ প্রেমিকা।
মন্তব্য করুন