ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

করোনায় নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা

করোনায় নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা

খান মাহবুব

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২০ | ০৪:৫১

মহামারি করোনা বিশ্ব ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে। উন্নত বিশ্বে সাতসকালে এখন মেট্রো কিংবা সিটি সার্ভিস বাসে স্যান্ডউইচ আর ধোয়া ওঠা কফি হাতে হন্তদন্ত যাত্রী নয়, বরং হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাতে জবুথবু লোকের দেখা মেলে। মাস্ক ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে শ্বেতবর্ণের সোনালি কেশ তরুণীদের সাতসকালে লিপস্টিক মাখা লাল টুকটুকে হাসির সাক্ষাৎ মেলে না। হ্যান্ডশেক আর গাল মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় মার্চ মাসের পর পশ্চিমা বিশ্বে উবে গেছে। ব্রিটিশরা হ্যান্ডশেকের পরিবর্তে এখন পায়ে পায়ে বাড়ি দিয়ে সম্ভাষণ রেওয়াজ চালু করেছে। হতে পারে করোনা-পরবর্তী বিশ্বে এটাই হবে স্থায়ী রেওয়াজ।

আর্থিক খাতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। করোনার কারণে ওয়ার্ক ফ্রম হোম এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হচ্ছে। গুগল এমন সব প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন করছে, যাতে ২০২১ সাল নাগাদ বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ ঘরে বসেই ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সহায়তায় অফিস করতে পারে। এই প্রবণতা স্থায়ী হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, কারণ করোনার ফলে অর্থনীতিতে ধসের ফলে সহসাই ব্যয়বহুল অফিস চালনা কষ্টসাধ্য হবে।

করোনার ফলে শেষ কবে রেস্তোরাঁয় গিয়ে কবজি ডুবিয়ে খেয়েছেন অনেকেই ভুলে গেছেন। স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে খাওয়া থেকে বেড়ানো- যে কোনো প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ার বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫৪ শতাংশ আমেরিকান নিজে রান্না করছেন। করোনা শুধু জীবনাচরণের রীতি-রেওয়াজের সাময়িক কিছু বিষয়ের পরিবর্তন ও সংকোচনেই থেমে নেই, বরং দীর্ঘদিনের সামাজিক প্রথাতেও স্থায়ী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। ব্যয় কমিয়ে পরিবার ছোট রাখা, এমনকি এক সদস্যের পরিবার গঠনেরও চিন্তা করা হচ্ছে।

জীবনের সর্বজনীন উৎসবগুলো করোনা ম্লান করে দিয়েছে। ক্যারিবিয়ানদের নটিংহিল কার্নিভাল, স্প্যানিশদের পোর্টোবেল্লোদোস্বজ্যান, ইতালিয়ানদের সাগ্রার মতো জমজমাট উৎসবগুলো এখন কেবলই স্মৃতির পাতার সোনালি অধ্যায়।

করোনায় বড় একটা ক্ষতির দিক হচ্ছে- বিশ্বমানবের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের স্থায়ী ক্ষতিসাধন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক বলেছেন, করোনা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। সামাজিকভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্ন মানুষ সংক্রমণভীতি, পরিবারের সদস্য হারানোর দুঃখ-কষ্ট, এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উপার্জন ও চাকরি হারানোর ভয়। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে, লাখ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে হয়তো কভিড-১৯-এর প্যানডেমিক মোকাবিলা করা যাবে কিন্তু এর প্রভাবে যে দ্বিতীয় ঢেউ আসবে সেটা হবে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্যানডেমিক। বহু মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবেন। অনেকেই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভোগবেন। করোনার কারণে শুধু নারীরা নয়, আক্রান্ত পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা কমে বন্ধ্যাত্বের দিকে বিষয়টি চলে যাবে।

করোনায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে কোমলমতি শিশুদের। তারা খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না, মনের আনন্দে ছুটতে পারছে না। দীর্ঘ বিরতিতে অনেক শিশু অক্ষর পর্যন্ত ভুলে গেছে। তাদের পাঠ্যক্রমের মূলধারায় আনতে অনেকটা সময় লাগবে। মোদ্দাকথা করোনার বৈশ্বিক প্রভাবে বিশ্বের বিরাজমান কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক। ফলে বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ইয়োভাল নোয়ার বলেন- মহামারির পর এমন এক গণনজরদারি রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব হবে যেখানে সরকার প্রতিটি নাগরিকের প্রতিটি মুহূর্তের চলাফেরা শুধু নয়- আবেগ, অনুভূতি, পছন্দ-অপছন্দের খবরাখবর রাখবে। এমনকি অনেক রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতে একলা চলার নীতিও গ্রহণ করতে পারে।

করোনা বিপর্যয়ে সমাজ, সরকার ও রাজনীতিতে ক্ষত ও দুর্বল দিক উঠে এসেছে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশের মানুষ জীবিকা ও চিকিৎসা নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ নতুন সরকার ও সমাজ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় বাস্তবতা দিয়ে উপলব্ধি করছে। মানুষের চোখে দিবালোকের মতো স্পষ্ট যুদ্ধ-বিগ্রহ, অযাচিত ভোগে যে পরিমাণ অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করা হয়েছে মানুষের টেকসই মৌলিক চাহিদার উন্নয়নের বিষয়টি সেই গুরুত্বে বিবেচিত হয়নি। এখন বেকায়দায় পড়ে সরকারযন্ত্র পরস্পরকে দোষারোপ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জাতিসংঘ অতীতের ধারাবাহিকতায় তাদের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী করেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক বিষয়ে বুজরুকি কথা বললেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনাবিষয়ক দায়িত্বের অসমর্থতার বিষয়টি যথার্থভাবেই তুলে ধরেছেন।

করোনার মহামারিতেও রণ ঝনঝনানি থেমে নেই। আমেরিকান বাহিনীর পারস্য উপসাগরে হুঙ্কার প্রতিদিন বাড়ন্ত। ইতালিসহ কয়েকটি দেশ ইইসি থেকে বের হওয়ার চিন্তা করছে। তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্র দেশ সৌদি আরবকে হুমকি দিতে এতটুকু কার্পণ্য করেনি।

বিশ্বে করোনা আমদানি করা দেশ চীন নিজেদের অনেকটা সামলে নিয়ে লাদাখ সীমান্তে নিজেদের ভূমি সম্প্রসারণে ভারতকে সামরিক চাপে রাখছে। করোনা প্রতিরোধের বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদন ও রপ্তানিতেও চীন একটি ঈর্ষণীয় নাম। এ প্রশ্ন আসতেই পারে চীন কী নিজেদের আরও সম্প্রসারিত করতেই স্বপ্রণোদিত হয়ে করোনা জীবাণু বিশ্বময় ছড়িয়েছে। যদি বিষয়টি সত্যি হয়, তাহলে বিশ্বমানবের কাঠগড়ায় এ জীবাণুযুদ্ধ সূত্রপাতের দায়ভার নিতে হবে চীনকে।

আন্তর্জাতিক বাজারে যুদ্ধ, বিপর্যয় বা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের শূন্যতা তৈরি করে বাজার দখলের একটা মোক্ষম কৌশল হিসেবে মানা হয়। করোনা বিপর্যয়েও চীন বাজার দখলের ক্ষেত্রে নিয়ামকের আসনে সমাসীন।

গুটি বসন্তের টিকা আবিস্কারে আমেরিকা ও রাশিয়া সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে বিশ্ব থেকে গুটি বসন্তকে ঝেঁটিয়ে তাড়িয়েছিল। করোনার টিকা উদ্ভাবনে সম্মিলিত উদ্যোগ নেই। অনেক দেশ চেষ্টা করছে টিকা আবিস্কারে। অপফোর্ডের ভ্যাকসিন ছাড়া এখনও কোনো টিকার প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি নেই। এখনও বিশ্ববাসী অনিশ্চিত কবে করোনার টিকা সহজলভ্য হবে। তবে করোনার টিকা আবিস্কার না হলেও টিকা নিয়ে কাজ করা ১৮০টি দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। ইতোমধ্যে ভারত অপফোর্ডের টিকা সফলকাম হলে সে টিকা উৎপাদন ও উপমহাদেশে বাজারজাতকরণের ছক এঁকে রেখেছে। ধারণা করা হয়, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে ব্যক্তিস্বাধীনতা কমে যাবে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মানুষের চলাফেরা থেকে শুরু করে জীবনাচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ইতোমধ্যে চীন নাগরিকদের স্মার্টফোন মনিটর করছে। চেহারা চিনতে পারে এমন ক্যামেরা দিয়ে মানুষের চলাফেরা মনিটর করা হচ্ছে। আগামী দিনে অবাক হবো না, যদি স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা বলে মানুষের শরীরে চিপ্‌স ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

করোনার করালগ্রাস বাংলাদেশকেও নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত করেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছিল আগামী দিনে বিশ্ব আর্থিক মন্দার কারণে বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবাসহ সকল কল্যাণকর্মে সংকোচন আসবে। আর্থিক ও মানসিক অবসাদ দীর্ঘমেয়াদি হবে। জীবিকার কারণে যারা শহরে থাকেন করোনার কারণে জীবিকা হারিয়ে তারা কেউ গ্রামে, কেউ দিকভ্রান্ত, এই শ্রেণির লোক সহসাই গ্রাম বা শহরে স্থির হতে পারবে না বরং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।

করোনায় নানামুখী বিপর্যয়ের পরও প্রকৃতি দীর্ঘমেয়াদি অবসাদ পেয়ে নিজেকে সাজিয়েছে নিজের মতো করে- যদিওবা ক্ষণিক সময়ের জন্য। একথা বলাবাহুল্য প্রকৃতির করোনাকালীন শিক্ষা যদি বিশ্ব মানব নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় গ্রহণ করতে না পারে তবে এই গ্রহ মানবজাতির জন্য আগামী দিনে অশনিসংকেত হবে। তাই জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করোনার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি ধারণায়। প্রকৃতির সন্তানেরা যেন মানুষের উন্মত্ততার শিকার না হয়, সেদিকে আমাদের সামষ্টিক খেয়াল আবশ্যক। যদি আমরা সচেতন হই তবেই আমাদের স্বাস্থ্য ও আর্থিক সুরক্ষাবলয় দৃঢ় হবে, আমরাও অনাদিকাল ধরে কক্সবাজার সৈকতে ডলফিনের জলকেলি দেখে সমুদ্র যাপন করতে পারব।





আরও পড়ুন

×