ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

সুবর্ণচর থেকে বেগমগঞ্জ: ধর্ষণের সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান

সুবর্ণচর থেকে বেগমগঞ্জ: ধর্ষণের সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান

রফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০ | ০১:৪৩ | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২০ | ০১:৫৭

ধর্ষণ মানব চরিত্রের আধিপত্যবাদী সামাজিক ভাবাদর্শের প্রকাশ। ধর্ষণ বিশেষ কোনো সমাজে সীমাবদ্ধ নয়। তবে বিভিন্ন সমাজ-সংস্কৃতিতে ধর্ষণের ঘটনার মাত্রা এবং ধরনের ভিন্নতা দেখা যায়। সুতরাং এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, ধর্ষণের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বস্তুতপক্ষে ধর্ষণকে বুঝতে হবে ধর্ষক পুরুষের সংস্কৃতি ও সমগ্র মূল্যবোধের আলোকে। ধর্ষণ এক ধরনের রাজনৈতিক অপরাধও বটে, যা নারীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং নারীকে পরাস্ত করে। একই সঙ্গে মানবতা, সামাজিক রীতিনীতি, সভ্যতা ও জীবন সংসারকে উপেক্ষা করে।

সমাজবিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী, সমাজ মোটামুটি সুসংহত ও স্থীতিশীল একটি ব্যবস্থা, যার ভিত্তি হচ্ছে স্বীকৃত মূল্যবোধ বা প্রতিষ্ঠিত সমাজিক রীতিপ্রথা। স্বীকৃত মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে পরিবর্তন সমাজের উপাদানগুলোকে পারস্পরিকভাবে প্রভাবিত করে থাকে। যেমন দারিদ্র্য বেড়ে গেলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। এক্ষেত্রে বেকার ভাতা পরোক্ষভাবে অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করে থাকে। বস্তুতপক্ষে সামাজিক মূল্যবোধ এবং আচরণে তারতম্য ঘটলে সমাজের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। তাছাড়াও ঐতিহ্যবাহী অনগ্রসর সমাজে যদি আকস্মিকভাবে আধুনিক প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ঘটলে ফল হিসেবে সমাজের বিভিন্ন উপাদান বা অংশের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সংঘটিত হয়। তাতেও সমাজের অংশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। এর ফলে দেখা দেয় নতুন নতুন সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়া এমনই ভারসাম্যহীনতার বহিঃপ্রকাশ।

ধর্ষণ একটি সামাজিক অবক্ষয়। এ সমস্যার তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান সম্ভব নয়। বিদ্যমান সমাজ কাঠামো তথা অনাকাঙ্ক্ষিত সামাজিক পরিস্থিতিই এর অন্যতম কারণ। সুতরাং অসংগত সমাজ কাঠামো বা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রেখে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। দায়সারা গোছের জোড়াতালিমূলক সমাধান তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে না। ধর্ষণের কারণ বিশ্নেষণে, সোশ্যাল ডিজঅর্গানাইজেশন, সংস্কৃতির ব্যবধান, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বৈষম্য, মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের বাইপ্রডাক্ট, ডেভিয়েন্স, জৈবিক ভিন্নতা, উপসংস্কৃতি তত্ত্বসহ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বা পারসপেকটিভ সমাজবিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত।

ধর্ষণের সাজা কম। সাক্ষী আদালতে যেতে ভয় পান। ভিকটিমের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয় না। প্রমাণের প্রক্রিয়া অনেক জটিল ও আদিম। টাকার বিনিময়ে আপস হয়। গ্রামে সালিশ করে আপস করা হয়, যা আসলে আপসের অযোগ্য অপরাধ। কখনও কখনও পুলিশ ধর্ষণকে গৌণ অপরাধ মনে করে। ধর্ষণ নিঃসন্দেহে বড় অপরাধ। যৌন বিকৃতি এখানে যতটা যুক্ত তার চেয়ে ক্ষমতার দাপট দেখানো কোনোভাবেই এখানে গৌণ নয়, ইত্যাদি পারস্‌পেকটিভ এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। অপকর্ম করে অপরাধীরা ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ভিডিও ভাইরাল করছে, যা ক্ষমতার দাপট দেখানোসহ অন্যায়ের ওপর অন্যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষমতার সংযুক্তি ধর্ষণের মতো অপরাধপ্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে অপরাধীর পক্ষে একটা নেকসাস বা বলয় তৈরি হয়, তখন ভিকটিম আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়। বস্তুতপক্ষে রাজনীতির বাইরে কিছুই নেই। এখানে অবক্ষয় শুরু হলে কিছুই বাকি থাকে না। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তের অংশ নেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং তাদের কোনোভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া যাবে না। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে অঙ্গীকার করতে হবে।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ার বাইরেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে না, তা নয়। ধর্ষক অনেক সময় আইনের মারপ্যাঁচে আদালতে জামিন পেয়ে যায়। সেখানে রাজনীতি কমই প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশ পেনাল কোড বা অপরাধ আইন অনুযায়ী যদি কেউ কোনো অপরাধীকে আশ্রয় দেয় তাহলে তারও জেল, জরিমানা ও শাস্তি হতে পারে। ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে এরকম ব্যাকট্র্যাক করে অপরাধ অনুষ্ঠানে সহায়তাকারী ও প্রশ্রয়দাতাদের শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। আমাদের কিছু মৌলিক বিশ্বাসের পরিবর্তন প্রয়োজন। 'ধর্ষণ সংঘটনের ক্ষেত্রে নারী উদ্দীপক হিসেবে দোষী', যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। রাজনীতির বাইরে মাদক, ধর্ষণের মতো অপরাধপ্রবণতাকে উৎসাহিত করছে; সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনায় আমরা সেটি দেখলাম। বর্তমানে ইন্টারনেটসহ প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক কিছুই হাতের নাগালে। অনেক বাবা-মা ব্যস্ত; সন্তানদের এসব খবর রাখার সময় প্রায়ই থাকছে না। আধুনিক প্রযুক্তির উল্লম্ম্ফন এর জন্য অনেকটা দায়ী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জয়জয়কার, অন্যদিকে অবক্ষয়ের স্রোত বইছে। অনেকেরই মনে থাকতে পারে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার বিচার চেয়ে প্রতিবাদ সভায় গুলি করে ১৭ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু তৎকালীন সরকার ওই ঘটনার বিচার করেনি। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ওই ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছিল।

স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৩ দশমিক ৫টি এবং ভারতে প্রতিদিন ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। করোনার কারণে মানুষের আর্থসামাজিক জীবন সংকুচিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। অসংখ্য মানুষ অতিদরিদ্রের কাতারে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে অবসাদগ্রস্ততা, যা ধর্ষণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণকে উৎসাহিত করছে। সরকার ধর্ষণের চূড়ান্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেছে, যার ফলে হয়ত ধর্ষণের সংখ্যা কমে আসবে। শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ কমানো সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত করে আবার মৃত্যুদণ্ড ফিরিয়ে এনেছে। ঘানা, নাইজেরিয়ায় ধর্ষককে নপুংশক করে শাস্তি দেওয়ার আইন রয়েছে। আফগানিস্তানে মাথায় গুলি করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আইন রয়েছে। শাস্তির বিধান ও তার যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণ, জীবনমুখী শিক্ষার সম্প্রসারণ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে এ ধরনের অপরাধ কমতে বাধ্য। নাগরিক হিসেবে প্রত্যেককে যার যার জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে।

শুধু সরকারের পক্ষে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সামাজিক সংহতি ও সামাজিক সচেতনতা। ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণ থেকে শিশুদের বের করে আনতে হবে। নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার শিক্ষা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করে তা চর্চার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অর্থবহ বিনিয়োগ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, শিশুরা পরিবারের বাইরে অধিকাংশ সময় স্কুলে থাকে। শিক্ষা ও সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে যেমন পরিবর্তন করতে পারে, তেমনি তার সমাজ ও প্রতিবেশে পরিবর্তন ঘটিয়ে পুরো সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন আনতে পারে।

আরও পড়ুন

×