দুর্যোগ পুনর্গঠনের সুযোগ করে দেয়
শফিকুল আলম
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০ | ০৩:৪৪
করোনার মতো দুর্যোগের অর্থনৈতিক দুর্ভোগ এবং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের নিত্যদিনের ভালো-মন্দের সম্পৃক্ততায় অনেকটা হতাশারই ছবি ফুটে ওঠে। একে তো করোনা মহামারিকে আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, আবার সঙ্গে যোগ হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা এবং হিসাব-নিকাশ চলছে ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে। ইতোমধ্যে ইউরোপে আবার অফিস-আদালত বন্ধের প্রক্রিয়া চলছে। আর করোনাকে একমাত্র দুর্যোগ ভাবা হবে অমূলক- ভিন্ন মাত্রার প্রাকৃতিক, জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা প্ররোচিত ও মানব সৃষ্ট দুর্যোগ সামনের দিনগুলোতে যে কোনো সময় হানা দিতে পারে। তবে দুর্যোগ আমাদের সামনে নিয়ে আসে পুনর্গঠনের সুযোগ এবং দেখিয়ে দেয় সহনশীলতা ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর পথ।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, প্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের খÿ অনেকটা বাছবিচারহীনভাবে প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশের ওপর এসে পড়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আঘাত হানা আম্পান, ২০০৭ সালের ভয়াবহ সিডরের পর সবচেয়ে মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়, যা রাস্তাঘাট, হাজার হাজার মানুষের বাড়িঘর ও অন্যান্য অবকাঠামোর অনেক ক্ষতি করেছে। তবে ক্ষতির মাত্রা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্ক ছিল, যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০০৭ ও ২০০৯ সালে উপর্যুপরি আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা-পরবর্তী সময়ে, উপকূলীয় এলাকার প্রস্তুতি ও সক্ষমতা না বাড়ানো হতো। বাস্তবিক অর্থে, ঘূর্ণিঝড় দুটি উপকূলীয় অঞ্চলগুলো তছনছ করে দেয় এবং রেখে যায় বিষণ্ণতার ছাপ- লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় খাবার পানির সংকট পর্যন্ত দেখা দেয়।
আইলার পর, সরকার ত্রিমুখী সমস্যায় পড়ে- উপকূলীয় লোকজনের জীবন বাঁচাতে তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেওয়া, স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরে আসতে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা এবং উপকূলীয় সম্প্রদায়ের সক্ষমতা ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়িয়ে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাত মোকাবিলায় প্রস্তুত করা। যদিও প্রস্তুতি পর্ব কিংবা সক্ষমতা অর্জন পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি, দেশি-বিদেশি সংস্থার সমন্বয়ে, সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, যেমন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং সৌরবিদ্যুৎ চালিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন করেছে। রাস্তাঘাটের সংস্কারও হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো উপকূলীয় মানুষের আম্পান মোকাবিলায় ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে, উপকূলীয় অঞ্চলে যারা এখনও পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধিজনিত সমস্যায় জর্জরিত, তাদের অভিযোজনে এবং সক্ষমতা অর্জনে সবুজ জলবায়ু তহবিলের আওতায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। কমিউনিটি ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে, এ প্রকল্প জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের, বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের জীবনযাত্রায় টেকসই পরিবর্তন নিয়ে আসবে। বলে রাখা ভালো, নারী ও মেয়েরাই দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে পানি সংগ্রহ করে পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রয়োজন মেটান। এক্ষেত্রে, প্রকল্পটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন আনবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। তদুপরি, মিষ্টি পানির অভাবে ফলন কমায় উপকূলীয় অঞ্চলের আর্থিক ক্ষতি মোকবিলায় এ প্রকল্প জলবায়ুবান্ধব জীবিকার সংস্থান করে দেবে।
আবার বন্যার কবলে পড়ে, প্রায় প্রতি বছর, বাংলাদেশ বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেক দিনের অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ সরকারের হস্তক্ষেপে এ দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। নির্দি্বধায় বলা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পৃথিবীর মাঝে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে, বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০২০ এ যেমনটি উঠে এসেছে কিংবা বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বন্যা ক্রমেই আরও ভয়ংকর রূপ নেবে। গত বন্যা অনেকটা সে রকম সতর্কবার্তা যেন দিয়ে গেল। কাজেই আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই; বরং প্রস্তুতি বাড়াতে হবে খারাপ সময়কে মাথায় রেখে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ড ও দুর্যোগের পর, অনেক কারখানাই কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করেছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও অনেক কারখানাতেই লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে।
এদিকে, বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা পরবর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়া আমাদের খুব ভালো কিছু উপহার দিতে পারেনি। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে আর করোনার মতো মহামারিতে আমরা কতটা ভঙ্গুর তা সহজেই বুঝতে পারছি।
আমাদের আজকের পৃথিবী অনেক বেশি অসম আর তা ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে করোনার সময়ে। এখন পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধের উপায় হলো মাস্ক ব্যবহার এবং বারবার পানি দিয়ে হাত ধোয়া। আর এতে করে মর্মভেদী কিছু বাস্তবতা সামনে চলে এসেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীর জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষের বাড়িতে হাত ধোয়ার পানি বা সাবানের ব্যবস্থা নেই। শঙ্কার কথা হলো, লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ফিরে যাবে যা দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের গত কয়েক দশকের অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে।
এদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। কারও কারও কাছে জমানো টাকা থাকায় তারা হয়তো খরচের ব্যাপারটা সামলে নিচ্ছেন; কিন্তু এ কথা সত্য যে, অনেকেই সহসা ভালো কিছুর সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে পরিবারকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ পরিবার সমেত বাড়ি ফিরে গেছেন।
কাজেই, করোনা-পরবর্তী পুনর্গঠন আমাদের গতানুগতিক পথে নিয়ে গেলে তা হবে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আর এটাই হয়তো সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে এই প্রজন্মের জন্য একমাত্র সুযোগ। যদি করোনা-পরবর্তী পুনর্গঠনকে শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিমাপ করা হয় এবং সহজ সমাধানের পথ খোঁজা হয়, তা বাস্তব জীবনের অনেক সমস্যাকে এড়িয়ে যাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণেও খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারবে না। ফলে, পুনর্গঠনে বিভিন্ন দেশের নেওয়া নীতিমালার কার্যকারিতাই অনেকটা হ্রাস পাবে।
পরিশেষে, পুনর্গঠনের এ সুযোগে আমাদের সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক প্রতিটি দিককে বিবেচনায় নিতে হবে। অবশ্য পুরো প্রক্রিয়াকেই ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত করা জরুরি; খেয়াল রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীব্যাপী ক্রমশ বেড়ে যাওয়া অসমতার কথা এবং যাদের সক্ষমতার অভাব তারা গুরুত্ব পাচ্ছেন কিনা। সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক উন্নয়ন টেকসই করার পদক্ষেপে পরিবেশ ও জলবায়ুকে হেলা না করে প্রকৃতির ওপর যেন আর চাপ না বাড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।
- বিষয় :
- চতুরঙ্গ
- শফিকুল আলম