ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

উত্তরের অবাক দেশটি থেকে যা শেখার আছে

ফিনল্যান্ড

উত্তরের অবাক দেশটি থেকে যা শেখার আছে

ড. কাজী ছাইদুল হালিম

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২০ | ০১:৪৩

মানুষগুলো বেশ শান্ত, লাজুক এবং অন্তর্মুখী প্রকৃতির। কাজের কথা ছাড়া এমনিতে তারা একে অন্যের সঙ্গে খুব কম কথা বলেন। অপরিচিত কারও দিকে তাকানো বা আগ বাড়িয়ে অপরিচিত কারও সঙ্গে আলাপ শুরু করা তাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নেই বললেই চলে। কর্ম এবং শখের আবর্তে ঘোরে তাদের জীবন। একটা সন্তান জন্মগ্রহণ করার পরেই অভিভাবকরা ব্যস্ত হয়ে যান তার শখ নিয়ে। অনেক শিশু তার বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দুই অথবা তিনটা শখে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এখানে অনেক মানুষ আছেন, যারা শৈশবের শখটাকেই আবার প্রাপ্ত বয়সে পেশা হিসেবে নেন। অভিভাবকরা কখনোই সন্তানের পড়াশোনা বা তাদের শখের ব্যাপারে পীড়াপীড়ি বা চাপ প্রয়োগ করেন না। পক্ষান্তরে তারা সন্তানের আগ্রহের প্রতি সর্বাধিক সহযোগিতা প্রদান করেন। ফিনিশ অভিভাবকরা শৈশব থেকেই তাদের সন্তানদের স্বনির্ভর হওয়ার শিক্ষা দেন নিত্যদিনের কর্মের মাধ্যমে যেমন নিজ হাতে খাওয়া, নিজের শোবার ঘর নিজে গোছানো, পরিস্কার করা এবং বাড়ির কাজ করে নিজের সাপ্তাহিক হাত খরচ অর্জন করা।

ফিনল্যান্ডের অধিকাংশ মানুষ যথা ৬৮.৭% খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, যার মধ্যে ৭০% ইভানক্লিস-লুথেরান, বাকিরা অর্থডপ খ্রিষ্টান। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে দ্রুততম বর্ধমান ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। ধর্মের ব্যাপারে ফিনল্যান্ডের মতো স্বাধীনতা পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা আমি জানি না। ফিনিশদের সততা, প্রতিশ্রুতি, দায়িত্ব এবং কর্মের ব্যাপারে কোনো আপস নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য বা যে কোনো সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডে আপনি সহজেই একজন ফিনিশ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে পারেন।

এখানের স্কুল ব্যবস্থাটা এমন যে, অভিভাবকদের তাদের সন্তানের পড়াশোনার পেছনে তেমন লেগে থাকতে হয় না। আবার গৃহশিক্ষক বা কোচিং সেন্টার ব্যবস্থাও এখানে নেই। ছাত্ররা তাদের স্কুলের সবকিছু স্কুলেই করে, ছোটখাটো যে সামান্য বাড়ির কাজ স্কুল থেকে আসে তা তারা নিজেরাই করতে পারেন। একটু ভাবুন তো আমাদের বাংলাদেশের স্কুল ব্যবস্থাটাও যদি এমন হতো! হয়তো আমরা চেষ্টা করলে একদিন হবেও। শুধু লেখাপড়া নয়, ফিনিশ স্কুলব্যবস্থা প্রতিটা শিশুকে একটা পরিপূর্ণ লাইফস্টাইল উপহার দেয়- যেমন খাবার প্রস্তুত করা, পোশাক বানানো, ছেঁড়া পোশাক সেলাই করা, লিঙ্গ সমতা, সততা, নিজস্ব পালার জন্য অপেক্ষা করা ইত্যাদি। ফিনিশ স্কুলব্যবস্থা বিশ্বের সবচেয়ে ভালো স্কুলব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি। অনেকে আবার এটাকে নাম্বার ওয়ানও বলে। ফিনল্যান্ড এবং এর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বাংলাদেশি অভিভাবক ও তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। আর আমার এই লেখাটা তাদের উদ্দেশ্যেই।

ফিনল্যান্ডে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি মালিকানাধীন। এখানে ফিনিশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য কোনো টিউশন ফি প্রদান করতে হয় না। ফিনিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়াশোনার জন্য বাংলাদেশি ছাত্রদের ক্ষেত্রে টিউশন ফি প্রযোজ্য। তবে পিএইচডি পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য কোনো টিউশন ফি লাগে না বরং গবেষণার বিষয় ভালো হলে ভালো অঙ্কের বৃত্তি পাওয়া যায়। অনেকে আমার কাছে জানতে চান যে, বাংলাদেশ থেকেই কি কোনো ফিনিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এবং বৃত্তি নিয়ে ফিনল্যান্ডে যাওয়া যাবে কিনা। না, এমনটি যাবে না। আপনাকে আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। তারপর অধ্যয়ন ভিসা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং অধ্যয়ন ভিসাপ্রাপ্তি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়; আপনাকে ভর্তি দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং অধ্যয়ন ভিসা দেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, অধ্যয়ন ভিসা নিয়ে ফিনল্যান্ডে এসে যখন আপনার পিএইচডি গবেষণা তদারকি প্রফেসর আপনার কর্মক্ষমতায় সন্তুষ্ট হবেন কেবল তখনই আপনার বৃত্তি পাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে, অন্যথায় না। স্নাতক এবং মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়াশোনার জন্য টিউশন ফি থাকলেও তাতে অনেক সময় অনেক ছাড় পাওয়া যায়। আর এ জন্য আপনাকে নিজে যোগাযোগ করতে হবে আপনার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এর উপযুক্ত সময় এখনই (নভেম্বর ও ডিসেম্বর), কারণ আগামী শিক্ষাবর্ষের ভর্তির আবেদন গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হবে জানুয়ারি ২০২১-এর শুরুতে।

আবহাওয়া এবং জাতিগত বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে ফিনল্যান্ডের অবস্থান একেবারে বাংলাদেশের বিপরীত মেরুতে। বাংলাদেশে যেমন আমরা সারা বছর সূর্যের আলো পাই, ফিনল্যান্ডের অবস্থা কিন্তু তেমনটা না। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সূর্যের দেখা তেমনটা মিলে না বললেই চলে। জুন এবং জুলাই মাসে সূর্যের প্রখরতা সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া ফিনল্যান্ডে সূর্য কিরণের স্বল্পতা সারা বছরই অনুভূত হয়। অনেকেই সূর্য কিরণকে সৃষ্টিকর্তার অশেষ নিয়ামত বলে থাকেন। কারণ সূর্য কিরণে আছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন-ডি যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। অনেক গবেষক এখন এও বলছেন, ইতালিতে করোনাভাইরাসে এত মৃত্যুর কারণের পেছনে অন্যতম হতে পারে তাদের ভিটামিন-ডি স্বল্পপতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ক্ষেতে-খামারে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে কিন্তু করোনাভাইরাস ততোটা কাবু করতে পারেনি। কারণ তারা কায়িক পরিশ্রমের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায়, যা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সূর্যের আলোর স্বল্পতার জন্য ফিনিশরা জন্ম থেকে সারা বছর ভিটামিন-ডি গ্রহণ করে থাকে। শিশুদের জন্য রয়েছে ভিটামিন-ডি ড্রপ আর বড়দের জন্য বিভিন্ন মাত্রার ভিটামিন-ডি ট্যাবলেট। অনেক ফিনিশ চিকিৎসক এখন এটা মনে করছেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর মৃত্যু হারের দিক দিয়ে ফিনল্যান্ড পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় কম আর এর সংযোগ থাকতে পারে ফিনিশদের নিয়মিত ভিটামিন-ডি গ্রহণের সঙ্গে। তাই বলব নিয়মিত ভিটামিন-ডি গ্রহণ করুন, কায়িক পরিশ্রম করুন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান, করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেকে এবং আপনজনকে রক্ষা করুন।

আয়তনের দিক দিয়ে ফিনল্যান্ড বাংলাদেশ থেকে প্রায় আড়াইগুণ বড় হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ৫.৫ মিলিয়ন। দেশটির বেশিরভাগ মানুষ শহরে বসবাস করেন এবং এক শহর থেকে আরেক শহরের অবস্থান বেশ দূরত্বে। এক শহর থেকে আরেক শহরে যাতায়াত, গ্রাম ও শহরের যাতায়াতের সুবিধার জন্য এবং তথ্যের আদান-প্রদানকে সহজীকরণে ফিনিশরা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সবসময় খুব মনোযোগী।

গত নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ফিনল্যান্ড উচ্চ প্রযুক্তি (হাইটেক) বিশেষ করে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ক্ষেত্রে বেশ মনোযোগ দেয় এবং অনেক বিনিয়োগ করে। তাই মনে হয় এ জন্যই দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগের দিক দিয়ে ফিনল্যান্ড ইউরোপের অন্যান্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশ এগিয়ে। এই দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগের কারণে করোনা মহামারি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্থবির করে দিলেও ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটি হয়নি। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান পদ্ধতিটা শুধু অনলাইনে চলে গেছে; শিক্ষকরা বাসায় বসে শিক্ষা প্রদান করছেন আর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়িতে বসে শিক্ষা গ্রহণ করছে। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় যদিও তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম অনেক আগেই শুরু করেছে, তবে পাঠদানের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও অনলাইনে চলছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কথা যদি বলি তাহলে বলব সেটা সম্পূর্ণই চলছে অনলাইনে। সম্পদের সীমাবদ্ধতার জন্য সর্ব পর্যায়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগের দিক দিয়ে ফিনল্যান্ডের সমপর্যায়ে যাওয়া এখন সম্ভব না হলেও, বাংলাদেশকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে ইন্টারনেটের গতি এবং সংযোগের সংখ্যা দুটোই বাড়ানোর। ভর্তুকি দিয়ে হলেও ইন্টারনেটসহ একটি ছাত্র একটি মোবাইল ফোন-কম্পিউটার নিশ্চিত করতে হবে। আর এভাবেই আমরা পারব ফিনল্যান্ডের মতো করোনা মহামারির মধ্যেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে! শিক্ষার ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড হতে পারে বাংলাদেশের পথিকৃৎ।



আরও পড়ুন

×