'আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না'
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন ভাষায় কথা বলতেন? সহজ উত্তর- বাংলা ভাষায়। হ্যাঁ, তিনি বাংলা ভাষাতেই কথা বলতেন। বাংলা ছিল তার প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা, গাঁয়ের ভাষা, জনগণের ভাষা; আর এ ভাষার জন্য তিনি জেল খেটেছেন, আন্দোলন করেছেন। এ ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত। তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো মাতৃভাষার ওপর সবচেয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রথমে মাতৃভাষা, পরে অন্য ভাষা। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে রাজনীতি, সমাজনীতি, সর্বোপরি প্রাত্যহিক জীবনের কোনো কর্মই সঠিকভাবে করা যায় না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাতৃভাষায় পাঠ্যক্রম চালু করার বিষয়ে দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলা ভাষার প্রচলন, শিখন ও প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদাকে সহস্রগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে তিনি শিল্পীদের অনুরোধ জানান যে, রবীন্দ্রনাথের একটি গান শোনাতে। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। শিল্পী জায়েদুর রহিম, সুধীন দাস ও অজিত রায় গানটি সমবেত কণ্ঠে গেয়ে শোনালেন' (রফিকুল ইসলাম, ২০২০)।

১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে একুশের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন। তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে। সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যতগুলো গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেবো। সে বাংলা যদি ভুল হয় তবে ভুলই চালু হবে। পরে তা সংশোধন করা হবে।'

এ বক্তব্যতে স্পষ্ট হয় যে, বঙ্গবন্ধু জনগণের ভাষায় কথা বলতেন। তার বক্তব্যে সবসময় জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হতো। বঙ্গবন্ধু ৫৫ বছরের জীবনে যখন যে অঞ্চলে যেতেন, তিনি তাদের ভাষায় কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন পর্যালোচনা করলে বাংলা ভাষার প্রতি তার যে অপরিসীম মমত্ববোধ তা প্রকাশ পায়। তার প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণ ও বাণীতে বাংলা ভাষার ঔদার্য, গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে। অনেকেই স্বপ্ন দেখেন। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখান। বঙ্গবন্ধু স্বপ্নচারী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা বিনির্মাণ। বাংলা হরফে লেখা। রবীন্দ্রনাথের গানকে মনে-প্রাণে ধারণ করে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহ চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙালির স্বপ্নকে তিনি ভাষা-আশায় রূপায়ণ করেছেন। গত কয়েক বছরে তার তিনটি বই প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২) শুধু তার জীবনকর্ম নয়। বাঙালি জাতির জন্য অমূল্য দলিল। বাংলা ভাষার অন্যতম আত্মজীবনী গ্রন্থ। এতে তার ভাষাপ্রেম ও রাজনৈতিক দর্শন এবং জীবন দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন- 'একজন মানুষ হিসাবে সম্পন্ন মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা। যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে তুলে ধরে। এমন করেই তিনি কথা বলেছেন এবং মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কখনও জটিল বাক্যে মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা করেননি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সরল ভাষায় কথা বললে গণমানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। তিনি সবসময় নিজেকে সাধারণ মানুষের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছেন। মা-বাবার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। তিনি মা-বাবার কথা প্রাণপণে প্রতিপালন করতেন। তার বাবা তাকে উপদেশ দিয়েছেন 'বাবা রাজনীতি করো আপত্তি করছি না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না।' (অসমাপ্ত আত্মজীবনী-২০১২)।

বাবার এ উপদেশ তিনি অবনত মস্তকে প্রতিপালন করেছেন। তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। প্রতিদিন ডায়েরি লিখেছেন। তার প্রাত্যহিক জীবনাচারে অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিশ্নেষণ করলে দেখা যায় বাক্য গঠনবিন্যাস প্রাঞ্জল। তিনি সাধারণ মানুষের মতোই তার জীবনী লিখেছেন। বুনন করেছেন আমাদের জন্য অসাধারণ দলিল। এ দলিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের অনিবার্য অংশ হয়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় গ্রন্থ 'কারাগারের রোজনামচা'। গ্রামসির প্রিজন নোট বই কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার রোড টু ফ্রিডম গ্রন্থের চেয়েও এক অসাধারণ গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধু যা দেখেছেন, যা ভেবেছেন তাই করার চেষ্টা করেছেন। সংগ্রামী জীবনের চার ভাগের এক ভাগ কাটিয়েছেন কারাগারে। কারাগার তার আরেক নিবাস। সংসার জীবনের চিরচেনা সময় উপভোগ করার সুযোগ তার হয়নি। রাসেল মায়ের সাথে জেলখানায় বাবাকে দেখতে যান। তখন ঘটে এক হৃদয়বিদায়ক অনুভূতির প্রকাশ। লিখেছেন- "৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে 'আব্বা বাড়ি চলো'। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। ও তো বুঝে না আমি করাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ওকি বুজতে চায়। কি করে বিদায় নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত কর এই পাষাণ প্রাচীর থেকে। দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।"

পিতার অনুভূতি আকুতি, রাসেলের আকুতি। বর্ণনার কৌশল অসাধারণ। পিতা হিসেবে সন্তানদের যে পরিমাণ তার দেওয়ার তা তিনি কোনোদিনই দিতে পারেননি। এমন বিসর্জন বাংলার ইতিহাসে দ্বিতীয় জনের নেই। এ জন্য তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

থালা বাটি কম্বল জেলখানার সম্বল। এমন বাক্য তার কলমে ফুটে উঠেছে। তিনি মনে করেন জেলের ভেতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে। তিনি বলেন, কারাগার আর একটা আলাদা দুনিয়া। তার বর্ণনায় কিছু শব্দ পাওয়া যায় যেমন- কাহিল, ব্যভিচার, বাঁশি, পাঁচ নাম্বার, রাইটার দফা, চৌকি দফা, জলভরি দফা, ঝাড়ূ দফা, বন্দুক দফা, পাগল দফা, শয়তানের কল, দরজি খাতা, মুচি খাতা, আইন দফা, ডালচাকি দফা, হাজতি দফা, ছোকরা দফা ইত্যাদি। জেলে থাকা অবস্থায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কথা তাকে গভীরভাবে ভাবাতো। তিনি লিখেছেন, "মনে পড়ল আমার বৃদ্ধ বাবা মার কথা। বেরিয়ে কি তাঁদের দেখতে পাব? তাঁদের শরীর ভাল না। বাবা বুড়া হয়ে গেছেন। তাঁদের পক্ষে আমাকে দেখতে আসা খুবই কষ্টকর। খোদার কাছে শুধু বললাম 'খোদা তুমি তাঁদের বাঁচিয়ে রেখ। সুস্থ রেখ।'"

তিনি বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অনেক নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। তার ভাষায়, "রাত কেটে গেল। একটু ঘুম আসে আবার ঘুম ভেঙে যায়। কারাগারে থাকাবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা ফোনে বলেন, তুই আমাকে দেখতে আয়। আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। আমি বাড়ি আসতেছি। বললাম, মা আমি শীঘ্রই বাড়ি যাব তোমাকে দেখতে।" মায়ের সাথে তার দেখা হয়নি। গ্রেপ্তার হয়েছেন। জেলে থেকেছেন। জুলুম সহ্য করেছেন। মায়ের প্রতি তার টান অনেক বেশি ছিল। ফলে তাদের জন্য বঙ্গবন্ধু সবসময় ভাবাতুর থাকতেন। গ্রামের মানুষ বঙ্গবন্ধু। রাজনীতির কারণে ছুটেছেন সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে। কারাগারে থাকাবস্থায় গ্রামের মানুষের অভাব তাকে তাড়িত করত। তিনি বলেন- 'অভাবের তাড়নায়, দুঃখের জ্বালায় আদম সন্তান গ্রাম ছেড়ে চলেছে শহরের দিকে। অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ছোটবেলার কত কাহিনীই না মনে পড়ল। কারণ আমি তো গ্রামেরই ছেলে। গ্রামকে আমি ভালোবাসি। কারাগারে ফলি মাছের কোফতা দিয়ে কলিজা রান্না করেছেন। তেমন স্বাদ হয়নি, তবুও মনের স্বাদ মিটিয়েছেন। কারাগারে আকাশ দেখার সুযোগ ছিল। মনের আকাশ তাই বেশি প্রসারিত করেছিলেন। কারাবাসের সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা স্মরণ করতেন। দেশের মানুষ, রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন তার চিন্তায় স্থান পেয়েছে। অনুভব করেছেন হৃদয় দিয়ে যা অন্য দশজন রাজনীতিবিদের চেয়ে ভিন্ন। তিনি বলেছেন- 'জেলের ভিতর আমি মরে যেতে পারি, তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।' এগুলো তার বিশ্বাসের ফসল। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালে অক্টোবরে চীন সফর করেছিলেন। তিনি যা দেখেছেন, বুঝেছেন তা সুন্দরভাবে তার ডায়েরিতে লিখেছেন যা ২০২০ সালে 'আমার দেখা নয়াচীন' নামে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। এই বইটি অসাধারণ বর্ণনায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। চীনের উন্নয়ন, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রাজনীতিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। ভ্রমণ উপভোগ করেছেন। দেশে ফিরেছেন তবে বলেছেন কী করবো ফিরে যে আসতে হবে। যে দেশের মা বোনেরা না খেয়ে মরে, সেই আমার জন্মভূমিতে। বঙ্গবন্ধু শিশুপ্রিয় ছিলেন। চীন সফরে গিয়ে চীনের শিশুদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে আমি ভালোবাসি।

নয়া চীনের উন্নয়ন দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। চীনের নাগরিকেরা ও সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে দেশের মঙ্গল নিশ্চিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুভূতি, 'ভাত কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মত প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়।'

বঙ্গবন্ধুর লেখনীতে, বক্তব্যে, রাজনৈতিক বাণীতে ভাষায় সারল্য অতুলনীয়। তার জীবনাশ্রিত লেখা আমাদের যে কোনো বয়সের পাঠককে আলোড়িত করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষা বাঙালি অনুধাবন করেছিলেন বলেই শেখ মুজিব 'খোকা' হতে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, আজ বিশ্ববন্ধু বলেও অভিহিত হয়েছেন। বাংলা ভাষা সকলের- এ ভাষার মর্যাদার জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। তাই তিনি অহংকার করে উচ্চারণ করেছিলেন- 'ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।' মূলত বাঙালি জাতির ভালোবাসায় চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই ছিল বাংলার মানুষের আশার আশ্রয়।