ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

পণ্যের দামে লাগাম টানবে কে?

পণ্যের দামে লাগাম টানবে কে?

রবিউল করিম মৃদুল

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২০ | ০৩:২৩

বেড়েই চলেছে গৃহস্থালি পণ্যের দাম। সাবান, সোডা, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট, লোশন, বেবি অয়েলসহ গৃহস্থালির বিভিন্ন পণ্য ও টয়লেট্রিজ পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাজার চলছে ইচ্ছেমতো। গৃহস্থালি বিভিন্ন পণ্য ও টয়লেট্রিজ পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো একই পণ্যের দাম মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে বছরে দু'বার বাড়িয়েছে। অথচ এ ব্যাপারে কারো কোনো তদারকি নেই। সেই সুযোগে অন্যায়ভাবে দাম বৃদ্ধি চালিয়ে যাচ্ছে মুনাফাখোর কোম্পানিগুলো। একদিকে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম; অন্যদিকে দাম বাড়ছে এসব গৃহস্থালি পণ্যের। নানামুখী বর্ধিত মূল্যের চাপে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক হিসাবমতে, বাসাবাড়িতে নিত্যব্যবহারের প্রসাধন পণ্যের দাম গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। আমরা দেখি, চাল, ডাল ও তেলের দাম একটু বাড়লেই চারদিকে হইচই পড়ে যায়। অথচ এসব পণ্য কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চাল-ডালের দাম নিয়ে যখন ব্যস্ত সাধারণ মানুষ, ঠিক সে সময়ে সবার অলক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলছে এসব পণ্যের দাম। ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একটি বহুজাতিক কোম্পানির কাপড় কাচা সাবান বিক্রি হয়েছে ১৬ টাকায়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এসে তার দাম বেড়ে হয় ১৭ টাকা। ছয় মাস পর ফের ওই সাবানের দাম বাড়িয়ে করা হয় ১৮ টাকা। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দুই টাকা বেড়েছে জনপ্রিয় এ সাবানের দাম। একইভাবে গত এক বছরে একটি বহুজাতিক কোম্পানির ৫০ গ্রামের টুথপাউডারের কৌটার দাম ১৫ থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে। দেশি একটি কোম্পানির টয়লেট পেপারের দাম এক বছরের ব্যবধানে ১৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৫ টাকা। ২৩ টাকার বাসন পরিস্কার করার সাবান হয়েছে ৩০ টাকা। ৪৫ টাকার আধা কেজি ডিটারজেন্টের দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫ টাকা। গত এক বছরে বিভিন্ন টয়লেট্রিজ পণ্যের দাম সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়ে ৩৭ শতাংশে ঠেকেছে।

বাজার বিশ্নেষকরা বলছেন, বাজারে একচেটিয়া দখল থাকার কারণে এভাবে নিয়ন্ত্রণহীন দাম বাড়াতে পারছে কোম্পানিগুলো। বিশেষ কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে বাজার একেবারেই তাদের দখলে। কোনো একটি কোম্পানি নিজের পণ্যের দাম বাড়ালে তাকে অনুসরণ করে অন্যরাও সমজাতীয় ওই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। যে প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা পণ্যের গুণগত মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে। দাম বাড়লেও পণ্যের মান বাড়ানো হয়েছে মর্মে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। একই মানের পণ্য ছয় মাসের ব্যবধানে বিক্রি করা হচ্ছে বর্ধিত দামে। ঠিক কী কারণে দাম বাড়ানো হলো, তার কোনো জবাব নেই। কেউ এর জবাব চায়ও না তাদের কাছে। এসব পণ্যের বাজারে সরকারের নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। ক্রমাগত ঠকছে ভোক্তা। ঠকছে সাধারণ মানুষ। লাভবান হচ্ছে বহুজাতিক ও দেশীয় গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদক কোম্পানিগুলো।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপেও দেখা গেছে, মানুষের ভোগ্যপণ্যের তুলনায় খাদ্যবহির্ভূত পণ্য খাতে খরচ বেড়েছে গেল বছর। বিবিএস প্রকাশিত মূল্যস্টম্ফীতির তথ্যেও দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত খাতের মূল্যস্টম্ফীতি বেশি।

গৃহস্থালি সংশ্নিষ্ট এসব পণ্যের ক্রমাগত দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানারকম চটকদার বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নিচ্ছে। একই পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে নানা রঙে, নানা ঢঙে। টেলিভিশন-পত্রিকা খুললেই বাহারি বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। বিশ্নেষকরা বলছেন, কোম্পানিগুলো পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিজ্ঞাপন ও বাজারজাতকরণে। অনেক ক্ষেত্রেই পণ্যের উৎপাদন খরচকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপন ও বিপণনের খরচ। বর্ধিত এই বিজ্ঞাপন খরচ কিন্তু কোম্পানি বহন করছে না। এ খরচ তারা চাপিয়ে দিচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর। বারবার দাম বাড়িয়ে বিজ্ঞাপন বিপণনের বাড়তি খরচ তুলে নিচ্ছে। শ্রমিক, কুলি-কামার, মুটে-মজদুরসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর পড়ছে বাড়তি চাপ। বর্ধিত দামের চাপে পড়ে সাধারণের দৈনন্দিন খরচের তালিকা কেবল লম্বাই হচ্ছে।

এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ে সন্তুষ্টি নেই জনসাধারণের মনে। চালের দাম সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে বসে আছে। তেলের দাম বেড়েছে, ডালের দাম বেড়েছে, বেড়েছে নুনের দাম। এক কেজি গরুর মাংস কিনতে কৃষকের চলে যাচ্ছে প্রায় এক মণ ধান। এক কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করে কৃষক হিমশিম খাচ্ছে এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি। তার ওপর যদি এভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকে গৃহস্থালি পণ্যের দাম, তাহলে জনসাধারণ যাবে কোথায়? এই বর্ধিত দামের চাপ থেকে তাদের উদ্ধার করবে কে? কে টেনে ধরবে ক্রমাগত দাম বাড়িয়ে চলা এসব কোম্পানির লাগাম? এভাবে স্বেচ্ছাচারীভাবে দাম বৃদ্ধি চলতে থাকলে সাধারণের জীবন আরও অতিষ্ঠ হয়ে পড়বে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে ধারা চলছে, তার সুফল কখনোই সাধারণ জনগণ ভোগ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের দৈনন্দিন খরচের তালিকা সন্তোষজনক অবস্থানে রাখা যায়। সাধারণ মানুষের চাওয়া খুব বেশি নয়। তারা চায়, দু'বেলা দু'মুঠো ভাত জুটুক, অন্তত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যে থাকুক। দৈনন্দিন খরচ সীমার বাইরে গেলে যে কোনো উন্নয়নে সাধারণ জনগণের সন্তুষ্টি আসে না। কাজেই এসব গৃহস্থালি ও টয়লেট্রিজ পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারেরই নিতে হবে সে উদ্যোগ।


আরও পড়ুন

×