প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
মাভাবিপ্রবি: গৌরবময় পথচলার দুই যুগ

মো. মোস্তাফিজুর রহমান
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ১০:২৪ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ১০:২৪
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) আজ (১২ অক্টোবর) ২৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা বিস্তারের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। তার আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সন্তোষে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মাওলানা ভাসানী তাঁর জীবদ্দশায় সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নানামুখী উদ্যোগ নিলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাঁর কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। মৃত্যুর পর তাঁর মাজার প্রাঙ্গণে তাঁরই নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলো। শুরু হয় বাংলাদেশের ১২তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চলা।
শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় চরম অবকাঠামো সংকটে ভুগতে থাকে। ট্রাস্টি বোর্ডের প্রায় ৫৭ একর জমিসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সরকারি নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলেও, এর খুব সামান্য অংশই ব্যবহার করা গেছে। পুরোনো দালানকোঠাগুলো প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী ছিল। এ ছাড়া স্কুল-কলেজসহ সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু পুরোনো প্রতিষ্ঠান পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। শুরুর দিকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। ছাত্রছাত্রীদের আবাসন সংকট ছিল চরমে। এমনকি একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন মতো জায়গা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে এ সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চলতে থাকে।
বর্তমানে আবাসিক হল রয়েছে ছাত্রদের চারটি এবং ছাত্রীদের তিনটি। ছাত্রদের জন্য নবনির্মিত ছয়তলা শেখ রাসেল হল এবং ছাত্রীদের জন্য দশতলা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলে সম্প্রতি আসন বরাদ্দ দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের আবাসিক সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হয়েছে।
বিগত ৫-৬ বছরে প্রায় ৩৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্যাম্পাসে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন, গবেষণাগার ও লাইব্রেরির মান উন্নয়ন, একটি ১২তলা একাডেমিক ভবন, পুরোনো হলের সম্প্রসারণসহ নতুন দুটি হল নির্মাণ, দশতলা প্রশাসনিক ভবন, পাঁচতলা মাল্টিপারপাস ভবন, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবনসহ ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্মগুলো ক্যাম্পাসকে মোহনীয় করে তুলেছে।
ভৌত অবকাঠামোগত এসব উন্নয়নের ফলে চলমান বিভাগগুলোর সংকট কাটিয়ে নতুন কিছু বিভাগ খোলা সম্ভব হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে ইতোমধ্যে ফিজিওথেরাপি, ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেটা সায়েন্স ও বাংলা বিভাগ খোলার অনুমতির জন্য পত্র দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি বিভাগে বর্তমানে শুধু মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। বিভাগটিকে পূর্ণাঙ্গরূপ তথা অনার্স চালু করার ব্যাপারেও ইউজিসিকে পত্র দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় শিগগিরই বিভাগ পাঁচটি খোলা সম্ভব হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইতোমধ্যে প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে। আশা করা যায়, শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজগঞ্জ ক্যাম্পাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রায়োগিক এ বিষয়টির পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু হবে।
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ খোলা হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় বিভাগটির প্রায়োগিক প্রাসঙ্গিকতা অপরিহার্য। বিভাগটি থেকে পাস করা পাঁচজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র কয়েক বছর আগে ক্রিমিনোলজি বিভাগ চালু করেছে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাভাবিপ্রবির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগই প্রথম এ বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান শুরু করেছে।
২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। করোনার মহাদুর্যোগের প্রায় শুরুর সময় থেকেই মাভাবিপ্রবিতে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অনলাইনেই দুই সেমিস্টারের ক্লাস ও পরীক্ষা শেষ করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের করোনাকালীন ভয়াবহ সেশনজট থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অটোমেশন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে বিভিন্ন ফি প্রদানসহ পরীক্ষার ফরম পূরণ করছে। ইতোমধ্যে অটোমেশন প্রক্রিয়ায় পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ করা হয়েছে।
কয়েকটি বিভাগ ইতোমধ্যে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে গবেষক ভর্তি করেছে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কয়েকজন গবেষককে পিএইচডি প্রদান করা যাবে। ২০১৩, ২০১৬ ও ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সমাবর্তনের আয়োজন করেছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনকারীরা বিসিএসসহ নানা সরকারি-বেসরকারি চাকরি প্রাপ্তিতে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বেশ কিছু মেধাবী সাবেক শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় জায়গা করে নিয়েছেন। কিছু সংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য গবেষণারত রয়েছেন। স্কোপাস ইনডেক্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গবেষকদের গবেষণা তথা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের সংখ্যা ও মান অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
আগামীদিনগুলোয় আরও অধিক সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ নানা প্রায়োগিক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে দক্ষ ও আলোকিত মানবসম্পদে তথা বিশ্বমানবে পরিণত হোক। জ্ঞান চর্চা, জ্ঞান সৃজন এবং বিতরণের মাধ্যমে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলস ভূমিকা রেখে চলুক মাভাবিপ্রবি– এই হোক তৃতীয় যুগে পদার্পণের প্রাক্কালে আমাদের একান্ত কামনা।
ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
rahmanmbstu@gmail.com